আসরের সেরা দুটি দলই কেবল ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে না, দুই বছরের বেশি সময় ধরে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে ধারাবাহিক দলও তারা। দুর্দান্ত পথচলায় আর্জেন্টিনার সামনে হাতছানি নিজ মহাদেশের প্রথম দল হিসেবে টানা তিনটি বড় শিরোপা জয়ের। অন্যদিকে, অজেয় পথচলায় নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্যের সন্ধানে কলম্বিয়া।
লাতিন আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছে শিরোপাধারী আর্জেন্টিনা ও ছন্দে থাকা কলম্বিয়া। ফ্লোরিডার হার্ড রক স্টেডিয়ামে খেলা শুরু হবে বাংলাদেশ সময় সোমবার সকাল ৬টায়।
এই ম্যাচে নির্ধারিত সময়ে খেলা শেষ না হলে থাকছে বাড়তি ৩০ মিনিট সময়। যা ছিল না নকআউট পর্বের অন্য ম্যাচগুলোতে। সেখানে মূল ম্যাচ সমতা থাকায় সরাসরি পেনাল্টি শুটআউটে নিষ্পত্তি হয় চারটি ম্যাচ।
শিরোপার দীর্ঘ খরা কাটিয়ে দারুণ সুসময় এখন আর্জেন্টিনার ফুটবলে। টানা তিনটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলছে লিওনেল স্কালোনির দল। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ আসরের পর প্রথমবার কোপা আমেরিকায় টানা দুটি শিরোপা জয়ের হাতছানি তাদের সামনে।
ফাইনাল পর্যন্ত তুলনামূলক সহজ পথ পাওয়া আর্জেন্টিনার সামনে এবার বলা যায় কঠিনতম প্রতিপক্ষ- গত ২৮ ম্যাচ ধরে অপরাজিত কলম্বিয়া। আর্জেন্টিনাও আছে ভালো ছন্দে, সবশেষ ৬১ ম্যাচে তাদের হার কেবল দুটি।
আর্জেন্টা্ইন মহাতারকা মেসির অর্জনের মুকুটে নতুন পালক যুক্ত হতে পারে এবার। তিনি ছাড়াও আরও তারকার দ্যুতিতে উজ্জ্বল থাকবে ফাইনাল। দেশের হয়ে শেষবার মাঠে নামবেন আনহেল দি মারিয়া। দলটির আক্রমণভাগে থাকবেন লাউতারো মার্তিনেস, হুলিয়ান আলভারেস। আর প্লে মেকার হামেস রদ্রিগেস ও উইঙ্গার লুইস দিয়াস আলো ছড়াবেন কলম্বিয়া দলে।
ইতিহাসের হাতছানি
লাতিন আমেরিকার প্রথম দেশ হিসেবে টানা তিনটি বড় শিরোপা জয়ের সুযোগ আর্জেন্টিনার সামনে। ২০২১ কোপা আমেরিকা, ২০২২ বিশ্বকাপ এবং এবারের কোপা আমেরিকা। ইউরোপে এমন কিছু করতে পেরেছে কেবল স্পেন। ২০০৮ ও ২০১২ সালে ইউরো জয়ের মাঝে তারা ২০১০ সালে জিতেছিল বিশ্বকাপ।
ইকের কাসিয়াস, শাভি এর্নান্দেস, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাদের কীর্তি ছুঁয়ে তাদের পাশে বসার দারুণ সুযোগ মেসি-মার্তিনেসদের সামনে।
এ নিয়ে তৃতীয় ফাইনালে খেলতে যাচ্ছে কলম্বিয়া। প্রথমবার ১৯৭৫ সালে ফাইনালে পেরুর বিপক্ষে হেরেছিল তারা।
২০০১ সালে দলটি দেশের মাটিতে পায় প্রথম শিরোপার স্বাদ। সেবার নিরাপত্তা ঝুঁকির জন্য খেলেনি আর্জেন্টিনা, দ্বিতীয় সারির দল পাঠিয়েছিল ব্রাজিল। কনকাকাফ অঞ্চলের কিছু দল অংশ নিয়েছিল একেবারে শেষ মুহূর্তে।
তাই, লাতিন আমেরিকার তিন পরাশক্তিকে পেরিয়ে এবার ট্রফি জিততে পারলে সেটি হবে কলম্বিয়ার ইতিহাসের সেরা জয়। ব্রাজিলকে টপকে গ্রুপ সেরা হওয়া, সেমি-ফাইনালে উরুগুয়েকে হারানো এবং সবশেষে ফাইনালে আর্জেন্টিনা হারাতে পারলে- যে কোনো দলের জন্য তা হবে অনেক বড় অর্জন।
যা কিছু ব্যবধান গড়ে দিতে পারে
এই আসরে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হওয়া অন্য যে কোনো দলের চেয়ে আক্রমণের শক্তির বিচারে অনেক এগিয়ে কলম্বিয়া। ২০২২ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে স্কালোনিদের বিপক্ষে হারার পর থেকে অজেয় হয়ে উঠেছে দলটি। এই সময়ে ৯ ম্যাচে তারা অন্তত তিনটি করে গোল করেছে।
এর পেছনে বড় ভূমিকা আছে লিভারপুল উইঙ্গার লুইস দিয়াসের। গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে নিজেকে ফিরে পাওয়া হামেস রদ্রিগেসের।
চলতি আসেরই যেমন ছয়টি গোলে অবদান রেখেছেন এক সময়ে রেয়াল মাদ্রিদ ও বায়ার্ন মিউনিখে খেলা রদ্রিগেস। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে এক আসরে যা সর্বোচ্চ।
সংবাদ সম্মেলনে লিওনেল স্কালোনি বলেছেন, রদ্রিগেসকে নিয়ে তাদের আলাদা কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে কলম্বিয়া অধিনায়ককে অকার্যকর করে রাখার চেষ্টাই হয়তো করবে তারা; বিশেষ করে রদ্রিগেসের ফ্রি কিক, কর্নার ও ক্রসগুলো নিয়মিতই হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর। এবার যেমন পেনাল্টির বাইরে ‘ডেড বল’ পরিস্থিতি থেকে পাঁচটি গোল করেছে নেস্তর লরেন্সোর দল।
অন্যদিকে আর্জেন্টিনা বল দখলে রেখে খেলতে পছন্দ করে। প্রতিপক্ষের খেলার ধরন পাল্টাতে বাধ্য করার সামর্থ্য রাখে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।
প্রায় প্রতি ম্যাচেই অসংখ্য সুযোগ তৈরি করে স্কালোনির দল। ইন্টার মিলানের হয়ে সেরি আয় দুর্দান্ত একটা মৌসুম কাটিয়ে আসা লাউতারো মার্তিনেস আছে দারুণ ছন্দে। চার গোল করে আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। দুটি গোল করেছেন আরেক স্ট্রাইকার হুলিয়ান আলভারেস।
বরাবরই খেলার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করে আর্জেন্টিনা। একটু ধীর গতিতে শুরু করে। তবে আক্রমণে যাওয়ার সময় বরাবরই বিপজ্জনক তারা।
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোল করা সহজ নয়। পোস্টের নিচে অতন্দ্র প্রহরী এমিলিয়ানো মার্তিনেসকে পেরিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন কাজ। চার ম্যাচে তাকে পরাস্ত করে প্রতিপক্ষ জালে বল পাঠাতে পেরেছে কেবল একবার।
পেনাল্টি শুটআউটে তো তার দেয়াল ভেদ করা আরও কঠিন। এখন পর্যন্ত ২৪ পেনাল্টির কেবল ১২টি যেতে পেরেছে জালে, এর ৯টি ঠিক দিকে ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়েছেন মার্তিনেস। বাকি তিনটি ছিল না লক্ষ্যে।
পোস্টের নিচে মার্তিনেসের দানব হয়ে ওঠার শুরু কোপা আমেরিকা দিয়েই, গত আসরের সেমি-ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে। সেবার টাইব্রেকারে তিনটি শট ঠেকিয়েছিলেন দীর্ঘদেহী এই গোলরক্ষক।
শেষের ঝলক?
আর্জেন্টিনার গ্রেটদের মধ্যে নিজের নামটা এরই মধ্যে খোদাই করে ফেলেছেন দি মারিয়া, আসছে ফাইনাল দিয়ে তিনি ইতি টানছেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের। ২০২১ আসরে ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনালে ব্যবধান গড়ে দেওয়া গোলটি করেছিলেন তিনিই। ইতালির বিপক্ষে ফিনালিস্সিমায়ও জালের দেখা পান তিনি।
এরপর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন; কাতার বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর ফাইনালেও গোল করেন দি মারিয়া। তার সামনে হাতছাড়ি চূড়ায় থেকে বিদায় নেয়ার।
“আমার মনে হয় না, এমন কিছুর স্বপ্ন আমি দেখতে পারতাম। এই প্রজন্মের খেলোয়াড়দের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাদের ছাড়া এসব কিছু আমি করতে পারতাম না। ওদের ধন্যবাদ যে, জাতীয় দলে আমার শেষ ম্যাচ হতে যাচ্ছে ফাইনাল।”
হয়তো তিনি একাই জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলবেন না। জাতীয় দলের হয়ে পথটা শেষ হয়ে যেতে পারে ৩৬ বছর বয়সী খেলোয়াড় নিকোলাস ওতামেন্দিরও। অবশ্য দেশের হয়ে আরও কিছু ম্যাচ খেলবেন তিনি। বয়সীয় তিন খেলোয়াড়ের একজন হিসেবে জায়গা পেয়েছেন আর্জেন্টিনার অলিম্পিক ফুটবল দলে।
দেশের হয়ে ১১৬ ম্যাচ খেলেছেন ওতামেন্দি। গত কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপজয়ী দলের অংশ ছিলেন অভিজ্ঞ এই ডিফেন্ডার।
মেসি কত দিন খেলবেন, তা এখনও পরিষ্কার হয়নি। তবে নিশ্চিতভাবেই কোপা আমেরিকায় তার শেষ ম্যাচ এই ফাইনাল। স্কালোনি চান, অধিনায়কের অবসরের সময় যতটা সম্ভব পিছিয়ে যাক।
“দিন শেষে তাকে একা ছেড়ে দিতে হবে এবং নিজেদের দিক থেকে আমরা জানি, আমরা তার জন্য দুয়ার বন্ধ করব না। সে যত দিন চায় আমাদের সঙ্গে থাকতে পারে, এমনকি অবসর নেওয়ার পরেও।”
ফাইনালের পথ
‘এ’ গ্রুপ সেরা হয়েই নকআউট পর্বে পা রাখে আর্জেন্টিনা। কানাডা, চিলি ও পেরুর বিপক্ষে তিন ম্যাচে পায় তিন জয়।
কোয়ার্টার-ফাইনালে এসে প্রথমবার গোল হজম করে আর্জেন্টিনা। একুয়েডরের বিপক্ষে টাইব্রেকারে প্রথম শট ক্রসবারে মারেন মেসি। কিন্তু ত্রাতা হয়ে আসেন এমিলিয়ানো মার্তিনেস। তার নৈপুণ্যে পেনাল্টি শুটআউটে জিতে দল পৌঁছায় সেমি-ফাইনালে।
উদ্বোধনী ম্যাচের প্রতিপক্ষ কানাডাকে আবার ২-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা মঞ্চে পা রাখে আর্জেন্টিনা।
৭ পয়েন্ট নিয়ে ‘ডি’ গ্রুপ সেরা হয়ে নকআউট পর্বে পা রাখে কলম্বিয়া; গ্রুপের তিন ম্যাচে প্যারাগুয়েকে ২-১ গোলে ও কোস্টা রিকাকে ৩-০ গোলে হারায় তারা, পরে ১-১ গোলে ড্র করে ব্রাজিলের বিপক্ষে। এরপর কোয়ার্টার-ফাইনালে পানামাকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে জায়গা করে নেয় সেমি-ফাইনালে। সেখানে পুরো দ্বিতীয়ার্ধ ১০ জন নিয়ে খেলেও উরুগুয়েকে হারায় ১-০ গোলে। আর সেমি-ফাইনালে জেতে উরুগুয়ের বিপক্ষে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh