ছবি: সংগৃহীত
কাজের সন্ধানে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে অভিবাসনে সহায়তাকারী বা দালালের খপ্পরে পড়ার ঘটনা অতি সাধারণ। ভিটেমাটি বেচে দালালের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার পর সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।
এই বাস্তবতার পরও বিদেশ যেতে এখনও দালালই ভরসা। প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার চেয়ে সহজ এবং ঝুঁকিপূর্ণ এ পথটিই বেছে নেন বেশির ভাগ বিদেশগামী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এ-সংক্রান্ত এক জরিপ বলছে, দেশের ৫২ শতাংশের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী বিদেশ যাওয়ার খরচ দালালের হাতে তুলে দেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা জমা দেন ৪ শতাংশেরও কম বিদেশগামী। বাকি ৪৩ শতাংশের মতো বিদেশগামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার ব্যয়ের অর্থ জমা দিয়ে থাকেন।
বিবিএসের ‘আর্থসামাজিক জনমিতিক জরিপ ২০২৩’ প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। গত বুধবার সংস্থার ওয়েবসাইটে জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে জনমিতিক জরিপটি বিবিএসের সব ধরনের জরিপের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক এবং বৃহৎ। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তথ্য-প্রমাণভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এ ছাড়া আর্থসামাজিক ও জনমিতি-সংক্রান্ত বিভিন্ন সূচকের তথ্য সরবরাহের উদ্দেশ্যও রয়েছে জরিপ পরিচালনায়। গত বছরের ১ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দৈবচয়নের ভিত্তিতে সারাদেশের প্রায় তিন লাখ খানা বা পরিবার থেকে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়া রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো শহরনির্ভর। রাজধানী বা শহর ছাড়া সেবা পাওয়ার সুযোগ নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল শ্রেণি গড়ে উঠেছে। প্রয়োজন বিবেচনায় গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা সম্প্রসারণ করা দরকার।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, শহরের চেয়ে গ্রামের বিদেশগামীরাই দালালের ওপর বেশি ভরসা করে থাকেন। বিদেশ যেতে দালালকে টাকা-পয়সা যারা দেন, তাদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ১০ শতাংশ গ্রামের মানুষ। বিভাগভিত্তিক উপাত্তে দেখা যায়, রংপুর বিভাগের অভিবাসনপ্রত্যাশীর সর্বোচ্চ ৫৫ শতাংশ বিদেশ যেতে দালালের সহায়তা নিয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, দালাল-নির্ভরতার প্রকৃত হার আরও বেশি। এ কারণে বিদেশগামীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। অভিবাসন ব্যয় অন্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বিদেশ যাওয়ার পরও চুক্তিমতো বেতন-ভাতা পায় না। যাওয়ার ক্ষেত্রে সব ধরনের সেবা এখনও রাজধানীনির্ভর। গ্রাম কিংবা মফস্বলে বসে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। এ সুযোগে একটা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এ কারণে দেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার খরচ সবচেয়ে বেশি। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জটিলতা এবং সব জায়গায় রিক্রুটিং এজেন্সি না থাকার কারণে বিদেশ যাওয়ার আগে পাসপোর্ট, মেডিকেলসহ এ রকম বিভিন্ন সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ দালালনির্ভর হয়ে যায়।
সমস্যা সমাধানে তাঁর পরমার্শ, বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি সেবাগুলো আরও সহজ করতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ ও দালালের খপ্পরে পড়ে সাধারণ মানুষ যাতে প্রতারিত না হয়, সে জন্য নিতে হবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম।
বিবিএসের প্রতিবেদনে অভিবাসনের একটি সংজ্ঞায় বলা হয়, সাধারণত বসবাস বা কাজের উদ্দেশ্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়াকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন বলা হয়। ন্যূনতম ছয় মাস অবস্থান হলেই কেবল তাকে অভিবাসন বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, অভিবাসনে সহায়তাকারীকে ‘দালাল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অভিবাসনের ব্যয় অংশে বলা হয়, বিদেশ যাওয়ার ব্যয় জোগানের ক্ষেত্রে ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ ঋণ করে থাকে। গ্রামীণ অভিবাসনপ্রত্যাশীর ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৬১ শতাংশ। সারাদেশের মধ্যে বরিশাল বিভাগের সর্বোচ্চ প্রায় ৬৯ শতাংশ ঋণ করে বিদেশ যাওয়ার ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। খরচের পরিমাণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, একই দেশে ভিন্ন উদ্দেশ্যে অভিবাসনে ব্যয় সমান নয়।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবে বাংলাদেশের অভিবাসীর সবচেয়ে বড় অংশ প্রায় ৩৫ শতাংশে ব্যয় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। পাঁচ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করেছেন প্রায় ১০ শতাংশ অভিবাসী। মাত্র ৫০ হাজার টাকায় গেছেন আধা শতাংশ। মালয়েশিয়ায় অভিবাসনে সবচেয়ে বড় অংশ ৩০ শতাংশে ব্যয় তিন থেকে চার লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯০ শতাংশই বিদেশ যাচ্ছে কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়া। বাকিরা কোনোরকম প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। বরং বিদেশে যাওয়ার পর কাজের প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন ২০ শতাংশ, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে সাধারণ শ্রমিকই সবচেয়ে বেশি। শীর্ষ ২০ গন্তব্য দেশে গড়ে ৭১ দশমিক ২৫ শতাংশ বাংলাদেশিই সাধারণ শ্রমিক। পেশাজীবী মাত্র ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। শীর্ষ গন্তব্য সৌদি আরবে যাওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ গেছেন শ্রমিক এবং ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ পেশাজীবী হিসেবে। দেশটিতে যাওয়া নারী অভিবাসী শ্রমিকের ৫০ দশমিক ৬৭ শতাংশই গৃহকর্মী এবং পেশাজীবীর হার মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh