২০০১ সালে পল্টনের বিশাল জনসমুদ্রে জনগণের উদ্দেশে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের রাজনীতির এক মহাকাব্যিক অধ্যায়ের অবসান হলো। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, চড়াই-উতরাই আর অদম্য সাহসিকতার প্রতীক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অনমনীয় দৃঢ়তা আর ‘আপসহীন’ সত্তাকে ধারণ করে তিনি বরণ করে নিলেন পরম সত্যকে। মুক্তিযুদ্ধের বন্দিত্ব থেকে শুরু করে তিনবারের প্রধানমন্ত্রিত্ব—তার রাজনৈতিক জীবন যেমন বর্ণাঢ্য, তেমনি ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। স্বামী ও সন্তান হারানোর শোক এবং দীর্ঘ রোগব্যাধি তাকে শারীরিকবাবে দুর্বল করলেও, জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তার আদর্শিক অবস্থান ছিল হিমালয়সম অটল।
শৈশব থেকে জিয়া ঘরনি
১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা খানমের ডাকনাম ছিল ‘পুতুল’। শৈশব থেকেই পরিপাটি ও ফুলপ্রিয় এই শান্ত মেয়েটি ১৯৬০ সালে তৎকালীন চৌকস সেনাসদস্য জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর তিনি পরিচিতি পান ‘খালেদা জিয়া’ নামে। তার দুই সন্তান তারেক রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো। ১৯৮১ সালে স্বামী জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অকাল বৈধব্য বরণ করেন তিনি। এর পরই শুরু হয় তার জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা।
রাজনীতির রাজপথে এক অনিবার্য উদয়
জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকাকালীন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না খালেদা জিয়া। কিন্তু দলের অস্তিত্ব রক্ষায় ১৯৮২ সালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই বিএনপির হাল ধরেন তিনি। সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার আপসহীন ভূমিকা তাকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বয়কট করে তিনি অর্জন করেন ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অভাবনীয় জয় পেয়ে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তিনি দেশের শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
সংগ্রাম, বন্দিত্ব ও ব্যক্তিগত বিসর্জন
খালেদা জিয়ার জীবন কেবল ক্ষমতায় আসীন হওয়ার গল্প নয়, বরং চরম প্রতিকূলতাকে জয় করার ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই শিশু সন্তানসহ তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে যুদ্ধবন্দী ছিলেন। ২০১০ সালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শৈশব ও যৌবনের স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের বাড়িটি হারান। অশ্রুসজল চোখে সেদিন বাড়ি ছাড়লেও তিনি কখনো আদর্শের প্রশ্নে মাথা নত করেননি। ২০০৭ সালের ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এবং পরবর্তী ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ সময় কারাবাস ও গৃহবন্দিত্বের অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন তিনি।
এক নিরলস কর্মবীর
খালেদা জিয়া ছিলেন একজন ক্লান্তিহীন প্রচারক। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মাত্র ১৪ দিনে তিনি দেশজুড়ে ১৪ হাজার কিলোমিটার সফর করেছিলেন। তার এই পরিশ্রম ও জনগণের প্রতি টানই তাকে প্রতিটি নির্বাচনে (যেখানে তিনি অংশ নিয়েছেন) অজেয় রেখেছিল। ২৩টি সংসদীয় আসনে লড়াই করে কখনোই পরাজিত হননি এই নেত্রী।
মহাপ্রস্থান
দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতা ও লিভার সিরোসিসের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হলেও শারীরিক ধকল ও দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ দশা তাকে তিলে তিলে নিস্তেজ করে দেয়। ২৩ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষবারের মতো ভর্তি হওয়ার পর আর চিকিৎসায় সাড়া দেননি তিনি। প্রিয় স্বদেশ আর কোটি ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এই মহীয়সী নারী।
বিষয় : খালেদা জিয়া
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আলী হোসেন
যোগাযোগ: +880244809006 ,01922575574
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
