রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ইতিহাসের একনিষ্ঠ ছাত্র হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্র ক্রেমলিনে আজ তিনিই শীর্ষে। এক সময় যে আসনে ছিলেন জার দ্বিতীয় নিকোলাস থেকে শুরু করে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচভ। ঠিক কোন কারণে তাঁর এই পূর্বসূরীদের ক্ষমতার মায়া কাটাতে হয়েছিল– সেটিও তিনি ভালোই জানেন। ক্রেমলিন অধীশ্বরদের ক্ষমতা হাতছাড়া হয়েছে প্রধানত দুই কারণে- এক. যুদ্ধে মারাত্মক হার এবং দুই. অর্থনীতির শোচনীয় অবস্থানের জন্য। তাই দীর্ঘদিনের মিত্র ও ঘনিষ্ঠ সহচর সের্গেই শোইগুকে ভেবেচিন্তেই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে হটিয়েছেন। তাঁর জায়গায় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভার পেয়েছেন অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেই বেলুসভ। দক্ষ ও সৎ বলে পরিচিত একজন অর্থনীতিবিদকে এই দায়িত্ব দিয়ে পুতিন একইসাথে এ দুটি বিষয়ই ঠেকাতে চান। এই পদক্ষেপ পুতিন ও তাঁর সমর্থকদের জন্য তাই স্বস্তির হলেও –অন্যদের জন্য (পশ্চিমাদের) যথেষ্টই উদ্বেগের।
পশ্চিমাদের জন্য বেলুসভের নিয়োগ এজন্যই বিপজ্জনক যে, তিনি রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রকে আরও সবল ও টেকসই করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবেন। দেশের শাসক পুতিনের যেসব বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে – তার সাথে সঙ্গতি রেখেই তা করা হবে। সুতরাং, বেলুসভের কারণে ইউক্রেনসহ মস্কোর সাবেক প্রজাদের কেবল নতুন করে ভাবার সময় এসেছে তাই-ই নয়, একথা পশ্চিমাদের জন্যও প্রযোজ্য।
গত মার্চের নির্বাচনে বিপুল ভোটে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি ৮৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, বড় এই জয় তার কর্তৃত্ব ও আত্মবিশ্বাসকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ইউক্রেনে আগ্রাসনের প্রথমদিকে তার কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে হওয়া বিপর্যয় এবং ভাড়াটে সেনাদের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের বিদ্রোহের মতো বিষয়গুলোও পেছনে ফেলতে পেরেছেন তিনি।
এরপর গত ৯ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে এক ভাষণ দেন পুতিন। রুশ জনতার উদ্দেশ্যে দেওয়া এ ভাষণে তিনি পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন, যারা নাকি আধুনিক সময়ের নাৎসিদের সমর্থন দিচ্ছে এবং পৃথিবীজুড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও আন্তঃসম্প্রদায় হানাহানিকে উস্কে দিচ্ছে, বা জিইয়ে রাখছে।
পুতিন হুঁশিয়ার করে বলেন, রাশিয়ার কৌশলগত পারমাণবিক শক্তি কাউকে মাতৃভূমিকে বিপন্ন করতে দেবে না। ন্যাটো জোটের মদদ্পুষ্ট ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার চলমান সংঘাতকে – বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসি-বিরোধী সংগ্রামের সাথে তুলনা করেন। এবিষয়ে তার মন্তব্য – হিটলারের বিরুদ্ধে তিন বছর টানা একাই সংগ্রাম করতে হয়েছে রাশিয়াকে, অন্যদিকে ইউরোপীয়রা সমর্থন দিয়েছে জার্মান ওয়ারমাখটকে (সামরিক বাহিনীকে)।
এই বর্ণনাকে ঐতিহাসিক ঘটনার বিকৃত উপস্থাপন বলে অনেকেই উড়িয়ে দিতে চাইবেন। কিন্তু, এখানে প্রথম সমস্যা হলো রুশ জনতার অধিকাংশই এটা বিশ্বাস করবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের অনেক মানুষই একে সমর্থন দেবে, যেমন পশ্চিমা দুনিয়ার ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতা, যিনি পুতিনকে উদারবাদ বিরোধী লড়াইয়ের মিত্র গণ্য করেন। তৃতীয় ও শেষ কারণ হচ্ছে, রাশিয়ার থেকে উদ্ভূত হুমকি আজ অনেক বেশি বাস্তবিক। সেটা এজন্য নয় যে, পুতিন আসলেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে চান অথবা তিনি পোল্যান্ডে আক্রমণ করবেন; বরং এই জন্য যে তার মাতৃভূমির সংজ্ঞা বহু বিস্তৃত – যেখানে এর 'স্বার্থরক্ষা' অবধারিতভাবে পশ্চিমাদের সাথে সংঘাতের সূচনা করবে।
তাই পুতিনের বক্তব্য খণ্ডনে কিছু বলার প্রয়োজন আছে। একথা সত্য ইউক্রেনে কিছু নব্য নাৎসি রয়েছে। একইভাবে রাশিয়ার পার্লামেন্টের রয়েছে অনেক কট্টর ডানপন্থী। তবু আত্মরক্ষায় ইউক্রেন যা করছে, তাকে ১৯৪১ সনে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়নে আগ্রাসনের সাথে তুলনা করা উচিত না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিপুল জানমালের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়। এজন্যই নাৎসিদের পতনে মস্কোর ভূমিকাকে ইতিহাসে গুরুত্ব দিয়েই দেখানো হয়েছে। কিন্তু, নাৎসিরা সর্বোতভাবে পশ্চিমা দুনিয়ার সমর্থন পেয়েছে এটি এমন এক মিথ্যা যা আজ অবলীলায় সত্যি বলে চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।
বাস্তবতা হলো– যুদ্ধের প্রথম দুই বছর নিষ্ক্রিয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা নাৎসিদের সাথে অনাগ্রাসন চুক্তি করেছিল, এবং পোল্যান্ডকে দুই পক্ষই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। পরে হিটলার এই চুক্তি ভঙ্গ করে যখন সোভিয়েত রাষ্ট্রে আগ্রাসন চালান, ততদিনে ইউরোপীয় মহাদেশের অধিকাংশই তার দখলে চলে এসেছে।
ইউরোপের যে অংশ তখনও নাৎসিদের দখলমুক্ত ছিল– তারা কিন্তু অপারেশন বার্বারোসাকে (হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ অভিযান) সমর্থন দেয়নি। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা ছাড়া এই যুদ্ধে মস্কো বিজয়ী হতো কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে – যেটা তার ভাষণের একপর্যায়ে পুতিন নিজেও স্বীকার করেছেন।
পুতিনের এই ভাষণের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হলো তার দেওয়া মাতৃভূমির ধারণা। যেটি রাশিয়ার বর্তমান আকার বা আন্তর্জাতিকভাবে তার স্বীকৃত সীমান্তের চেয়েও অনেক বড়। রাশিয়ানদের বড় এতে বিশ্বাস করেন। রুশ অর্থনীতি বা জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে রাশিয়ার আধিপত্য আরো বিস্তার করতে চান পুতিন।
এই মনোভাবের ব্যাখ্যা জানতে, আমাদের ১৯৯১ সনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ে যেতে হবে। সমাজতন্ত্রের আদলে গড়া নতুন সাম্রাজ্য যখন ভেঙে খান খান হচ্ছিল। এই ইতিহাসের অনেক বিষয়ই আজো অমীমাংসিত এবং যা নিয়ে বিতর্ক দিনকে দিন আরো তীব্র হচ্ছে।
পুতিন বলেছেন, মাতৃভূমি বিপন্ন হলে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিধা করবে না। এ ইঙ্গিতের মধ্যে 'মাতৃভূমি' মানে কেবল রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে সংঘটিত কোনো আক্রমণ নয়, বরং সাবেক কোনো অধীনস্থ অঞ্চল মস্কোর সামনে মাথা নোয়াতে অস্বীকার করলে – তখন তার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এই সংজ্ঞা প্রযোজ্য হবে। এই নীতির মাধ্যমে রাশিয়াকে পুনরায় বিশ্বমঞ্চের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় ফেরাতে চান রুশ রাষ্ট্রপ্রধান। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনের মতো রাশিয়াকে আবারো সবাই সমীহ করে চলুক এটাই তার একান্ত বাসনা।
পুতিন বর্তমানে ইউক্রেনের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে ব্যস্ত আছেন, কিন্তু একই কাজ তার অসমাপ্ত আছে বাল্টিক সাগর তীরের সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে। বলকান অঞ্চল ও মধ্য ইউরোপে মস্কোর প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাও বাকি। আর এজন্য মস্কোকে অন্যান্য শক্তির দাপট কমিয়ে নিজেকে আরো পরাক্রমশালী করতে হবে। একাজে পুতিন যতই সাফল্য পাবেন, ততো দ্রুতই অর্ধসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে উদ্যমী হবেন।
পশ্চিমা দুনিয়ার তথাকথিত বাস্তববাদীদের আজ এই বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু, যতোটা মনে করা হয়– এটি ততোটা সহজ নয়। রাশিয়ার সাবেক অধীনস্থদেরও নিজস্ব স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি এখানে জড়িত। দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতায় তাঁরা স্রেফ পশ্চিমাদের প্রক্সি নয়।
যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে রুশ বাহিনীকে কিয়েভের দ্বারপ্রান্ত থেকে তাড়িয়ে দিতে সমর্থ হয় ইউক্রেনীয়রা। যখন তাদের কিছু ট্যাংক-বিধ্বংসী মিসাইল দিয়েছিল পশ্চিমারা। আর এই অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে অনেক বাগাড়ম্বর করা হয়েছে। আসল লড়াইটা হয়েছে ইউক্রেনীয়দের সাহসের। একইভাবে নিজ দেশের সরকারের ওপর রাশিয়ার প্রভাব নিয়ে অসন্তুষ্ট জর্জিয়ার নাগরিকরা আবারো রাজধানী তিবলিসির রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে।
সাবেক অঞ্চলগুলোর এই বিদ্রোহ দমন এবং তাঁদের ওপর মস্কোর অধিকার প্রতিষ্ঠাকে নিজের নিয়তি বলে মনে করেন পুতিন। তার বিশ্বাস, পূর্বসূরীদের কাছে এটি তার দায়। এই বিশ্বাসের গভীরতা সবে ইউরোপীয় নেতারা বুঝতে শুরু করেছেন। কিন্তু, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যস্ততায় তাঁরা নতুন রাশিয়ার হুমকি সম্পর্কে যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারছেন না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশকেই পুতিনকে ঠেকাতে মজবুত প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বেলুসভকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে পুতিন দীর্ঘমেয়াদি যে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তা অনেক ব্যয়বহুল হতে চলেছে। তবে নিষ্ক্রিয়তার জন্য যে মূল্য দিতে হবে, সেই বিকল্পের তুলনায় এটা সস্তাই।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh