একুশ শতকে এসেও নারীকে নানামুখী সমস্যার
সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সাফল্য, নারীর উচ্চশিক্ষা, নারীর নিরাপত্তা
প্রভৃতি নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও
দিনশেষে এটাই স্বীকার্য যে, আজও আমাদের সমাজে নারী পুরুষতান্ত্রিকতার করাল গ্রাসে নিপাতিত।
নারী তার মেধা, শ্রম দিয়ে প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে গেলেও এ সমাজ নারীকে টেনেহিঁচড়ে
নিচে নামাতেই ব্যস্ত।
নারীর জীবনযাপন-চলাফেরায় বিধিনিষেধের অন্ত
নেই। তবু নারী যে স্থবির জীবনযাপন করছে তাও নয়! বরং এ সমাজকে টেক্কা দিয়ে অনেকেই এগিয়ে
যাচ্ছে। পরিবারের সহযোগিতা, ভালোবাসা ও সহানুভূতি তাদের অন্যতম চালিকাশক্তি। যদিও অধিকাংশ
নারীই তা পান না। কন্যা সন্তানকে যদি পরিবার যথার্থ সাহায্য করে তবে পথচলাটা নারীদের
জন্য কিঞ্চিৎ সহজ হয়ে যায়। কারণ কন্যা সন্তানকে পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে
হয় তারপরও যদি সেই লড়াই ঘর থেকে শুরু করতে হয় তবে তা বেশ কষ্টের! একইসঙ্গে আত্মপীড়নের।
জীবনের জন্য প্রতিটি দিনই নতুন। সে নতুন
বছর হোক বা যেকোন দিনের সূচনা৷ যে ব্যক্তি একে একে জীবনের ষাটটি বছর পার করে ফেলেছেন
তার জন্যও আগামীকাল নতুন। সেই দিনের সূচনায় অপেক্ষা করে নতুন জীবনের ভাবনা, চেতনা,
কল্পনা ও অভিজ্ঞতা। নারীরাও প্রতিটি দিনে নতুন করে চেনে তাকে। কারণ পুরুষের তুলনায়
নারীর জীবনের ডাইমেনশন আরও দীর্ঘ পথের। এক পরিবেশ থেকে আরেক পরিবেশে নারীর যাত্রা ঘটে।
তিনি হন স্ত্রী,পুত্রবধূ, মা, শাশুড়ি। নারীর জীবনের দীর্ঘযাত্রায় তাকে নানা অভিজ্ঞতার
মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তদুপরি রয়েছে তার ব্যক্তিক জীবনের টানাপোড়েন যেগুলো সমাজের আর
দশটা মানুষের সঙ্গে সবসময় ভাগ করেও উঠতে পারেন না তারা। সবকিছু সামলে নারীকে যাত্রা
করতে হয় যুদ্ধের এক ময়দান থেকে অন্য ময়দানে। কখনও তিনি পরাজিত কখনো বা বিজয়ীর শিরোপাধারী!
এই দীর্ঘ পথচলায় তাই পাশের মানুষদের সাহায্য নারীর একান্ত কাম্য হয়ে ওঠে।
আমরা জানি, পরিবারে আজও নারীকে যথার্থ
মর্যাদা, সম্মান-শ্রদ্ধা করা হয় না। নারীর অভিমতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যে নারী একটি
সংসারকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন তাকেই নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। এখনও অনেক পরিবারে নারীর
প্রতি পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। যৌতুকের চাপ, বাল্যবিবাহের চাপ, শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামীর
মাত্রাতিরিক্ত শাসন, বিধিনিষেধ সবই নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এরপর রয়েছে নারীকে পারফেক্ট
বউমা, স্ত্রী, মা হওয়ার দৌড়। নারীর এই শতভাগের দৌড় তার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। পরিবারের
সাহায্য-সহযোগিতা-সহমর্মিতা, অনুধাবনের ক্ষমতা ছাড়া নারীর জীবন যে সুখের নয় তা কে না
জানেন! তবু আমাদের সমাজ নারীকে কিঞ্চিৎ ছাড় দিতে নারাজ। বরং নারী যদি তার অধিকারের
কথা মুক ফুটে বলেন বা কখনও প্রতিবাদ করে বসেন সেক্ষেত্রে নারীকেি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো
হয়। কারণ এ সমাজ নারীকে সব মেনে নিতে, মানিয়ে নিতেই শিখিয়েছে। পরিবারে কন্যা সন্তান
জন্ম নেওয়ার পর তাকে বোঝানো হয় সমাজের যত প্রতিকূলতায় আসুক না কেনো তাকে একা হাতে সব
সামাল দিতে হবে। কেউ অন্যায় করলে প্রতিবাদ না করে বরং চুপ করে থাকাটাই ভদ্রতা। আর সংসারে
তো স্বামীই প্রভু। সেখানে নারীর কোনো অভিমতই গ্রহণযোগ্য নয়। কর্তার ইচ্ছেয় সেখানে কর্ম
হয়। আর আবহমান নারী এই মতের বাইরে যেতে পারেননি। আজকের যুগে এসে যে নারীরা তার ওপর
হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে এ সমাজ দিনশেষে তাকে কুলটা, অভদ্র নানান নামে অভিহিত
করতেও দ্বিধা করে না! নতুন বছরে নারীর প্রত্যাশা এই যে, নারীর সুদিন আসবে। পরিবারে-সংসারে
নারীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। নারী তার যোগ্য মর্যাদা পাবেন।
পরিবারেই নয় নারীরা কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি
অনিরাপদ। অফিসের বস থেকে সহকর্মী সবার কুদৃষ্টি বাঁচিয়ে চলা নারীর জন্য রীতিমতো আরেক
লড়াই। সেখানেও নারীর অগোচরে তাকে নিয়ে কুৎসা ছড়াতে বিবেকে বাধে না অধিকাংশের। কিন্তু
যদি অফিস-আদালতে সর্বক্ষেত্রে নারী সম্মানের অধিকারী হতো, নারীর প্রতি সহোযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে উঠতো তবে
দেশের সামগ্রিক চিত্রই পরিবর্তন হয়ে যেতো। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুস্থ-সুন্দর
সমাজ পেতো। কথায় আছে মানুষ বাঁচে আশায়, নারীরাও স্বপ্ন দেখেন নতুনের সূচনায় অবশ্যই
মানবিক বোধের উন্মেষ ঘটবে। নারী মা-বোন হয়ে সমাজে সবার সম্মানের পাত্রী হিসেবে পরিগণিত
হবেন।
গণপরিবহনে নারী সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। পুরুষতান্ত্রিক
সমাজে নারী না পারে সইতে না পারে বলতে! তবু যদি কেউ মুখ ফুটে প্রতিবাদ করে তবে গণপরিবহনের
চালক থেকে শুধু করে যাত্রী কেউই ওই নারীকে আর রেহাই দেন না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণপরিবহনে
নারীদের উপর যৌন নিপীড়ন হওয়ার অনেক ঘটনাই সামনে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, নারীরা ধর্ষিত
হয়েছে বাস, লেগুনা, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, এমনকি নৌকায়ও। যৌন নির্যাতন বা হয়রানি হয়েছে
ট্রেনেও। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রাপ্তবয়স্ক নারী থেকে শুরু করে তরুণী, কিশোরী এমনকি
শিশুও।
দেশের ৫০.৪ শতাংশ নারী হলেও আজবধি গণপরিবহন
নারীবান্ধব নয়। নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন-হয়রানি, ধর্ষণের মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে। অথচ প্রতিকারের
কোনো উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি! যার ফলে নারীরা এ ধরনের সমস্যা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেতে
পারে। পত্র-পত্রিকা, মিডিয়াতে, কলামে নানাভাবে নারীদের এমন দুর্ভোগের কথা গুরুত্বসহকারে
বলা হলেও কর্তৃপক্ষ আজও যেন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে নারাজ। নারীদের নিয়ে কাজ
করা সংগঠনের চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিদিন ১০ লাখ নারী গণপরিবহনে যাতায়াত করেন।
এই বৃহৎ অংশের প্রত্যেক নারীই কোনো-না-কোনোভাবে যৌন হেনস্তার শিকার!
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কর্মজীবী নারীর
সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৬ শতাংশ। তবে এই নারীদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত
হওয়ায় তাদের প্রায় অধিকাংশই গণপরিবহনে যাতায়াত করেন। সামর্থ্য অনুযায়ী এই নারীরা যখন
চলাচল করেন তখনই সমাজের কদর্য দৃষ্টি তাদের গিলে খায়। পুরুষদের সঙ্গে নারীরাও সমানতালে
এগুতে গিয়ে পুরুষদের থেকেই হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে নারীকে। ব্র্যাকের গবেষণা বলছে,
গণপরিবহন চলাচলকৃত নারীদের ৯৪ শতাংশ নারীরা মৌখিক বা শারীরিক হয়রানির শিকার হন। ব্র্যাকের
‘নারীর জন্য যৌন
হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে,
শারীরিকভাবে যৌন -হয়রানির ক্ষেত্রে ৮১ শতাংশ নারীর বক্তব্য, তারা চুপ থাকেন এবং ৭৯
শতাংশ বলেছেন, তারা স্থান পরিত্যাগ করেন বা গণপরিবহন থেকেই নামতে বাধ্য হন। নতুন দিনে
নারীর চাওয়া এটাই যে, গণপরিবহনে নারীর সুস্থ-স্বাভাবিক যাতায়াত ব্যবস্থা। এলক্ষে অবশ্যই
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নারীদের জন্য বিভিন্ন রুটে আলাদা বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
আর যদি একান্তই তা করা সম্ভব না হয়ে ওঠে তবে অবশ্যই গণপরিবহনে নারীর আসন নিশ্চিত করতে
হবে। এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যদি নারীদের আসন খালিও থাকে কোন পুরুষ যাত্রী
সেখানে বসতে পারবেন না। যদি এমন কঠোর আইনের প্রয়োগ করা যায় তবে নারীরা অন্তত কিছুটা
স্বস্তিতে চলাচল করতে পারবেন৷
সর্বক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত
করতে হবে রাষ্ট্রের অন্যতম উপাদান মানুষ। আর তার অর্ধেকটাই নারী। যদি নারীর অধিকার
নিশ্চিত হয় তবে সন্তান সুশিক্ষা পাবে।
আমাদের সমাজে আজও কর্মজীবী মায়ের প্রতি
সহমর্মিতা, সহোযোগিতা গড়ে ওঠেনি। সন্তানের
সব দায় যেন একা মায়ের। পরিবারে বাবার ভূমিকা যে কিছু থাকে তা আজও এ সমাজ কোনোভাবেই
মানতে চান না। শুধু টাকা উপার্জন ও যোগানই যে যথেষ্ট নয় তা এ সমাজের পুরুষেরা কবে বুঝবেন?
নারী যখন ঘর-সংসার-সন্তান সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তখন পুরুষের সহোযোগিতা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
স্বামী হিসেবে তার পাশে থাকা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা নারীকে আরও বেশি পরিবারের প্রতি
দৃঢ় করে তুলতেই সাহায্য করবে। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনও মধুর থেকে মধুরতর হবে এটাই স্বাভাবিক
কিন্তু তার কোন চর্চা আজও এ সমাজে নেই। নতুন বছরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দেওয়াল টপকে
পুরুষ ‘মানুষ’ হয়ে উঠুক। সেখানে
লিঙ্গের দাপট নয় বরং কর্তব্যের ডালি নিয়ে পায়ে পায়ে লাগিয়ে সমান তালে চলার দীক্ষা লাভ
করুক।
অনলাইন প্লাটফর্মে নারীকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা
প্রদান করা বাঞ্ছনীয়। নারীর সম্মান জাতির সম্মান কিন্তু সেই সম্মানও আজ ধূলায় ভূলুণ্ঠিত।
অনলাইনে একশ্রেণির অসাধু নারীর ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে নানারকম
ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। কখনও টাকা হাতিয়ে নিয়ে খান্ত দেয় আবার কখনও তা গড়ায় সম্ভ্রম
পর্যন্ত! এ সমাজে আজও এমন অসংখ্য নারী আছেন
যারা লজ্জায় কারো সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন না আবার দিনের পর দিন লাঞ্ছিত-নিপীড়িত
হচ্ছেন! তাই নারীর নিরাপত্তার স্বার্থে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। যাতে আর কেউ এ
ধরনের ট্রাপে পা না দেয় সে বিষয়ে সেমিনার, সভা, টিভিতে ছোট নাটিকা, বিজ্ঞাপন দিতে হবে।
আগামীর দিনগুলো নারীর জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলুক। সব অপমান, অসম্মানকে রুখে দাঁড়ানোর
মনোবল জন্ম নিক। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক।
পেশা নির্বাচনে নারীর প্রতি উদারতা জাগ্রত
করতে হবে। আজও অধিকাংশ মানুষের মাঝে যেকোনো পেশায় নারীকে দেখার অভ্যাস বা আস্থা জন্ম
নেয়নি। বরং যখন ২০২৩ সালে নারীরা ফায়ারসার্ভিসে যোগ দিলেন, মেট্রোরেলের চালক হলেন,
রেলের টিটি হলেন তখন নানা সমালোচনা-কটুক্তি করতে দেখা গেছে। কিন্তু সমাজ গঠনে নারীর
ভূমিকা কোন অংশে কম নয় তাই নারীরাও কোথাও পিছিয়ে থাকবেন না এটাই স্বাভাবিক। পুরুষের
সঙ্গে তাল মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবেন।
গৃহকর্মে নিযুক্ত নারীর কাজের মূল্যায়ন
এ সমাজে হয় না। যে নারীরা গৃহকর্মে নিপুণা এবং সুন্দরভাবে পরিবার পরিচালনা করেন তাদের
সুষ্ঠু মূল্যায়ন প্রয়োজন তবেই সংসার সুখের হবে। পরিবারের অধিকাংশ কাজই নারীকে করতে
হয়। বলা চলে শতভাগই নারীরাই করে থাকেন। সন্তান লালন-পালন থেকে শুরু করে সবার দেখভাল
পর্যন্ত নারীকে করতে হয়। কিন্তু দিনশেষে নারীর কাজের কোনোই মূল্যায়ন নেই। গৃহস্থালির
কাজে নারী কোনোদিন অর্থমূল্য পায় না। এমনকি নারীরা তা আশাও করেন না। কিন্তু যা আশা
করেন তা হচ্ছে মানসিক সাপোর্ট। কাজের স্বীকৃতি। তবু এ সমাজে অধিকাংশ পুরুষই নারীর কর্মকে
কাজের মধ্যেই ধরেন না। এমনকি নানা অনুযোগ-অভিযোগে কান ভারী করে তোলে! পরিবারের সব দায়
নারীর ওপর না চাপিয়ে ভাগ করে নেওয়ার প্রবৃত্তি গড়ে উঠুক।
শ্রমজীবী নারীর উপর্যুক্ত বেতন-ভাতা প্রদান
করতে হবে। জন্মলগ্ন থেকেই পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সভ্যতার চাকা সচল রাখতে সমান পরিশ্রম
করে চলেছে। কিন্তু নারীকে কৃষি খাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে পুরুষের সমান পারিশ্রমিক
দেওয়া হয় না। একজন নারী শ্রমিকও পুরুষের মতো ফসলের পরিচর্যা, মাটি কাটা, ধানের চারা
রোপণ, ইটভাটায় কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজে সহোযোগিতা, ইটভাঙা প্রভৃতি কাজ করে থাকেন। সকাল
৯ থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত আমাদের দেশে স্বাভাবিক কর্মঘণ্টা ধরা হয়। সে অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে
একদিনের পুরুষ শ্রমিকের মজুরি ৪০০ টাকা। অন্যদিকে একই কাজে নারীর জন্য নির্ধারিত ২০০-
২৫০টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে আরও কম মজুরি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরি তথা
আনুষ্ঠানিক কাজে নারী-পুরুষের বেতনবৈষম্য কম হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে তা প্রকট এখনো।
নারীরা ন্যূনতম পারিশ্রমিকেই কাজে অংশগ্রহণ করছেন। সেক্ষেত্রে বারবার বেতন বৈষম্যের
কথা উঠে এলেও নারীদের অধিকার রক্ষায় শক্তিশালী ভূমিকা নেই কারও!
শুধু পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রেই নারী শ্রমিকরা
বঞ্চিত হচ্ছেন তা নয়। বরং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকেও নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি বঞ্চিত
করা হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও তা চোখে
পড়ার মতো। বেতন-ভাতার পাশাপাশি কর্মবিরতি, অবকাশ যাপনের বিষয়ে নারীর সঙ্গে এক ধরনের
রূঢ় আচরণ করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীকে মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটি মওকুফ দেওয়া হয়।
নিঃসন্দেহে তা ভালো উদ্যোগ। তবে কোনো কাজে যদি বাড়তি ছুটির আবেদন গৃহীত হয় সেক্ষেত্রে
পুরুষ সহকর্মী, অফিসের বসের কাছ থেকে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য হরহামেশাই নারীকে শুনতে
হয়। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানে পুরুষের অতিরিক্ত কাজ নারী সহকর্মীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
কারণ এ সমাজ- রাষ্ট্র নারীকে অবহেলা-বঞ্চনার শিকারে পরিণত হওয়াকে বেশি প্রাধান্য দেন।
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বদৌলতে নারীরা তাদের যোগ্য মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। কাজের নিরাপত্তা
নিশ্চিত হচ্ছে না। আর আমাদের সমাজের মানসিকতা আজও পরিবর্তিত নয় এটাও তার বড় প্রমাণ।
নতুন বছরে নারী শ্রমিকদের এই দৈন্য কেটে যাক। নতুন দিনে নবসূর্যের উদয় হোক।
গৃহকর্মীর প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হোক
সবার। যুগের পরিবর্তন আসলেও মানসিকতায় বার্ধক্য বিদ্যমান। গৃহকর্মীরাও যে মানুষ এ সমাজের
মালিকশ্রেণি তা ভুলতেই বসেন। গৃহকর্মীর প্রতি কোনরকম মানবিক বোধ তাদের তৈরি হয় না।
কারণে-অকারণে গৃহকর্মীর ওপর নিপীড়ন চালানো বন্ধ হোক। মানবিক বোধের উদয় হোক নতুন বছরে।
গৃহকর্মীরা মানুষ তাদের জন্যও ভালোবাসার স্ফূরণ ঘটুক মানব মনে।
প্রবাসী নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও
নতুন বছরে নারীর আশার একটি বিরাট অংশ। প্রবাসী নারীরা দেশের রেমিট্যান্স খাত সৃষ্টি
করছে কিন্তু তারা যদি অনিরাপদ জীবনযাপন করে তবে তার চে মানবেতর আর কী হয়! প্রবাসীকল্যাণ
ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২০২০ থেকে ২০২২ সালের তথ্য মতে, এই তিন বছরে ৪০৪
জন নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। তাঁদের মধ্যে ২২৭ জনের ক্ষেত্রে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’লেখা ছিল। বেসরকারি
উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক দেশে আসা নারী শ্রমিকদের লাশের তথ্য আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে।
এই সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় , ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ৭১৪ নারী
শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। তাঁদের মধ্যে ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যুর সনদ
লেখা লাশের সংখ্যা ২৬২। আর ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে ৩১৯ নারী শ্রমিকের লাশ
দেশে আসে। তাদের মধ্যে ২২০ জনের ক্ষেত্রে লেখা ছিল ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’। এত নারীর স্বাভাবিক
মৃত্যুর খবরটা কতটা স্বাভাবিক, তা আমরা অনুমান করতে পারি।
ব্র্যাকের গত সাত বছরের পরিসংখ্যান বলছে,
এই সময়ে যেসব নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে, তাদের মধ্যে ১৩৮ জনের মৃত্যুর কারণ লেখা
ছিল ‘স্ট্রোক’। ১১৬ জনের ক্ষেত্রে
‘আত্মহত্যা’। ১০৮ জনের ক্ষেত্রে
‘দুর্ঘটনা’। ১৬ জনের ক্ষেত্রে
‘হত্যা’। এর বাইরে করোনা,
ক্যানসার, অজানা রোগ বা কোনো কারণ উল্লেখ না করেই দেশে নারী শ্রমিকের লাশ পাঠানোর ঘটনা
ছিল। প্রবাসে নারী নির্যাতন বন্ধের লক্ষে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা
আবশ্যক। কারণ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা তো আছেই
তাছাড়া জনগণ যদি চোরায় পথে গিয়ে পড়ে সে দায় সরকারের ওপর চাপানো ঠিক নয়। কারণ দেশের
বাইরে বৈধ পথে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আজকাল সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নির্যাতন এড়াতে প্রথমত
বৈধ পথ অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। কোনো প্রকার দালাল বা অবৈধ বেসরকারি এজেন্সি, চক্রের
ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খুঁইয়ে প্রবাসে পাড়ি জমানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তা নাহলে দেশের
বাইরে যাওয়ার পর নারীদের দায়ভার সরকার বহন করতে ব্যর্থ হবেন।
বিগত কয়েকদশকের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নারীর
জীবনযাত্রার মান অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। পূর্বের তুলনায় নারীরা এখন বেশ আত্মনির্ভরশীল।
এর কারণ সমাজে বেশ কিছু বড় বড় পদে নারীর পদচারণা। যার দরুণ অভিভাবকমণ্ডলী সাহস পাচ্ছে
তার কন্যাসন্তানও আরেকজন সফল নারীর মতো নিজ পায়ে দাঁড়াক। নিজের কর্মগুণে পরিবারের দায়িত্ব
কাঁধে নিতে সক্ষম হোক। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর অংশগ্রহণকে নস্যাৎ করতে সর্বদাই
উৎসুক। নারীর কোনকিছুই তাদের চোখে ভালো না। এই হীন ও পাশবিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটুক।
নতুন বছরে নারী সব ধরনের অনিয়ম, অবিচার, নিপীড়নের উর্ধ্বে উঠে দেশের সেবার নিয়োজিত
হওয়ার ব্রত গ্রহণ করুক।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh