× প্রচ্ছদ জাতীয় রাজনীতি অর্থনীতি সারাদেশ আন্তর্জাতিক খেলা বিনোদন ফিচার প্রবাস সকল বিভাগ
ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ

জাতীয় সমাজসেবা দিবস-২০২৫

বঞ্চিতদের কল্যাণ, সামাজিক সুরক্ষা ও পেশাগত অঙ্গীকার

লেখা: মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ

০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৭ পিএম । আপডেটঃ ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫১ পিএম

মানুষ চায় সেবা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। যখন সে অসহায়, দুর্গত ও নিগৃহীত হয়। সমাজে বিবিধ শ্রেণির মানুষ বসবাস করে। অবস্থা ও অবস্থান ভেদে মানুষের সক্ষমতা এক নয়। দেশের নাগরিকগণ জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্র নানা সমস্যায় ভুগছে। যেমন: শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন। অপরদিকে প্রান্তিকতা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, আঞ্চলিকতা ও অনগ্রসরতার কারণে দেশের মানুষ সামাজিক বৈষম্যের শিকার। হরেক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে দুর্বিসহ হয়ে উঠছে মানুষের জীবন। কিন্তু মানুষ মাত্রই মর্যাদাবান। প্রত্যেক নাগরিক চায় ন্যায্যতা, নাগরিক অধিকার, ও সামাজিক মর্যাদা। নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অসহায় মানুষগুলো মর্যাদাবান হয়। আবার প্রাকৃতিক ও অ-প্রাকৃতিক দৈব দুর্যোগের শিকার হয়ে অনেক মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। দুরারোগ্য ব্যাধি, দুর্ঘটনা, অগ্নিকান্ড, বন্যা, মহামারি, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, তুফান, টর্নেডোসহ অনেক কারণে দেশের অনেক মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বস্ব হারিয়ে দুর্গত মানুষ হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সেবামূলক উদ্যোগ ও কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

আজ ২ জানুয়ারি জাতীয় সমাজসেবা দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “নেই পাশে কেউ যার, সমাজসেবা আছে তার”। হয়তো পাঠকের মনে প্রশ্ন, কেন এ দিবস জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে ? মানবসেবা এক মহৎ সেবাকর্ম। কিন্তু সেবা কর্মের পরিধি ও ব্যাপকতা সীমাহীন। তাই, সামাজিক অবস্থার প্রয়োজনে সেবার চাহিদা নিরূপন এবং সেবা কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। সমাজের বঞ্চিত মানুষের অবস্থা, দুর্দশা ও হতাশার চিত্র সমাজের সকল পক্ষের কাছে প্রত্যক্ষকরণের লক্ষ্যে এ দিবসের আয়োজন। সমাজকল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ, কল্যাণমূলক ধারণা প্রচার করা ও সামাজিক সচেতনতা জাগ্রতকরণ এ দিবস পালনের অন্যতম বিষয়। সরকার ২০১২ সালের ৪ জুন জাতীয়ভাবে পালনের জন্য রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। এ ধারবাহিকতায় প্রতিবছর দেশব্যাপী ২ জানুয়ারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালায় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের নেতৃত্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। জাতীয় কর্মসূচির আলোকে দিবসের তাৎপর্য বিবেচনায় এ বছর দিবসটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সামাজিক সংগঠনসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণে পালন করা হচ্ছে।

আদিকাল হতে মানুষের কল্যাণে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। মানবতাবোধ, পরস্পর মমত্ববোধ ও পরকালীন মুক্তির প্রত্যাশায় মানুষ স্বেচ্ছায় কল্যাণমূলক উদ্যোগ পরিচালনা করে থাকে। সমাজসেবামূলক উদ্যোগের অনন্য অনুপ্রেরণা ধর্মীয় মতবাদ। ধর্মীয় দর্শন ও মানব হিতৈষী দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে কল্যাণমূলক উদ্যোগে তাড়িত করে। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল হতে কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা ও সেবামূলক উদ্যোগের প্রচলন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষ অভাবগ্রস্ত, দুঃখী, অসহায় ও সমস্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এ অঞ্চলে ইসলামী ধর্মপ্রচারকগণ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দরগাহ স্থাপন করে এবং সংলগ্ন এলাকায় কূপ স্থাপন, পুকুর খনন, ধর্মীয় পাঠশালা, লংগরখানা স্থাপন ও অভাবগ্রস্তদের সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাচীন ভারতবর্ষে সমাজকর্ম চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘জটাকাস’ সাহিত্য চিত্রে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক বুদ্ধের অনুশাসন মালায়। এ সাহিত্যে ত্রিশ জন যুবকের সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মে আত্ম-নিয়োগের বিষয় উল্লেখ আছে। প্রাচীন পন্ডিত কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেন, “প্রজাদের সুখই রাজার সুখ এবং রাজা এতিম, বৃদ্ধ, অক্ষম, ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায়দের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করবে”। সম্রাট অশোক কলিঙ্গ লিপিতে বলেছেন,“প্রজা মাত্রই আমার সন্তান; তাদের ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মঙ্গল সাধন আমার একমাত্র লক্ষ্য”। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় অনেক সমাজ হিতৈষী সমাজসেবা ও সমাজ সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আছে। যাদের মধ্যে অন্যতম হাজী মুহাম্মদ মহসীন, স্যার সৈয়দ আহমদ, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নওয়াব আব্দুল লতিফ, বেগম রোকেয়া, বেগম ফয়জুন্নেসা প্রমুখ। ব্যক্তি উদ্যোগে সমাজসেবায় তাদের অসাধারণ অবদান অদ্যাবদি স্মরণীয়।

বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক সমস্যাসমূহ উত্তরণে সমাজসেবা কর্মসূচির প্রবর্তন। ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধকল্পে কিছু সামাজিক আইন প্রবর্তন করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম ‘ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় আইন-১৯৪৩’ এবং ‘বিধবা ও শিশুসদন আইন-১৯৪৪’। তৎকালীন সামাজিক আইনসমূহ প্রণয়নের মাধ্যমে এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজসেবা কার্যক্রমের সূচনা হয়। প্রণীত আইনসমূহের লক্ষ্য ছিল ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন, ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ, বিধবা পুনর্বাসন ও এতিম শিশু সুরক্ষা। পরবর্তীতে দেশ বিভাজন পরবর্তী দেশত্যাগী মানুষের সমস্যা ও নগর অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক সংকট নিরসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টিমের সুপারিশে দেশে আধুনিক সমাজকল্যাণ কর্মসূচি প্রবর্তিত হয়। শুরু হয় শহর সমাজসেবা কার্যক্রম, হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম ও পেশাদার সমাজকর্মীর জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। কর্মসূচিসমূহ পরিচালনার জন্য পৃথক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৬১ সালে সামাজকল্যাণ পরিদপ্তর সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর’ হিসেবে উন্নীত হয় এবং ১৯৮৯ সালে ‘সমাজকল্যাণ’ নামে পৃথক মন্ত্রণালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তর একটি বহুল কর্মসূচিসমৃদ্ধ ও জাতিগঠনমূলক প্রতিষ্ঠান। এ দপ্তর সমাজের অসহায়, নিগৃহ, বিপন্ন ও বঞ্চিত মানুষের তরে বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় এ অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে প্রায় ৫৪ টি কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বাস্তবায়িত কর্মসূচিসমূহের অন্যতম লক্ষ্য সামাজিক সমস্যা নিরসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ‘সামাজিক সমস্যা’ হচ্ছে সমাজের এক অনাকাঙ্খিত অবস্থা যা সমাজে মূল্যবোধগত সংশয় সৃষ্টি করে এবং সমাজে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। আবার ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ হচ্ছে নাগরিকের প্রাপ্যতা অনুসারে সম্পদের সুষমবন্টন সুনিশ্চিত করা। ‘সমাজসেবা’ একটি পৃথক কল্যাণমূলক উদ্যোগ। যাতে পৃথক পৃথক সমস্যা নিরসন করার প্রচেষ্টা। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে পরিচালিত সমাজসেবা কর্মসূচিসমূহ কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। যার মধ্যে অন্যতম বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা, হিজড়া ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা, শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমসহ অন্যান্য কর্মসূচি। বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তর দেশব্যাপী বিবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ১.২৫ কোটির অধিক ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হিসেবে যুক্ত করেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর সরকারের এক বৃহৎ সেবামূলক দপ্তর। এ দপ্তরের মাধ্যমে সরকার ও জনগণের মধ্যে মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।

সমাজসেবা অধিদপ্তর দেশের প্রান্তিক, বঞ্চিত, অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া মানুষের আস্থার ঠিকানা। এ দপ্তর দেশের অনগ্রসর শ্রেণি, হিজড়া জনগোষ্ঠী ও দুর্গত মানুষের জন্য বিশেষ কর্মসূচি পরিচালনা করছে। যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে: দেশে নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার ও দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। তাছাড়া সামাজিক সাম্য, অসমতা দূরকরা ও মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দায়িত্বপ্রাপ্ত। সময়ের আবর্তে নতুন কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ এ মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। বৃদ্ধি করতে হবে সেবাকর্মের পরিসর, সৃজন করতে হবে নতুন কর্মপদ, পেশার মানোন্নয়ন করতে হবে এবং দপ্তরকে তরুণ কর্ম প্রত্যাশীদের আকর্ষণীয় কর্মক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সমাজসেবা অধিদপ্তর তারুণ্যের নব চেতনায় জাগ্রত এক নতুন সেবামূলক দপ্তর হিসেবে দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক।

বিশ্বায়নের যুগে দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত সামাজিক, অর্থিনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটে পতিত হচ্ছে। সংকট মোকাবিলা করতে সরকারকে চাহিদা মাফিক কল্যাণ প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। সমাজকল্যাণ এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। এ কর্মপ্রচেষ্টার সফলতা নির্ভর করে সম্মিলিত কর্ম প্রয়াসে। সমাজের বঞ্চিত মানুষগুলো সামাজিক সুরক্ষা ও মানবিক সাহায়তা প্রার্থনায় সর্বদা সক্ষম মানুষদের দিকে নিরবে তাকিয়ে থাকে ক্ষীণ সহানুভূতি ও স্বল্প ভালবাসার প্রত্যাশায়। নিগৃহীত ও বঞ্চিতদের পাশে থাকার মাঝে ব্যক্তিসত্ত্বার উৎকর্ষতা নিহিত। সুপ্রতিষ্ঠিত হয় মানবমর্যাদা। সমাজকর্ম শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় একক দায়িত্বের অংশ নয় বরং সমাজের সকল সক্ষম নাগরিকের সমন্বিত কর্তব্য। সমাজসেবায় সকলের সার্থক অংশগ্রহণ চাই। সমাজসেবা সমাজকর্মীদের ধ্যান ও সাধনা অসহায় ও বিপন্ন মানুষের সেবা হোক আমাদের পেশাগত অঙ্গীকার।

  • মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ লেখকএম এস এস (সমাজকল্যাণ) ঢা:বি, এম এস এস (মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচার) জগ:বি:, বি,কম, (অনার্স) এম, কম, (ব্যবস্থপনা) জাবি; অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসবো একাডেমী, আগারগাঁও, ঢাকা।মোবাইলঃ ০১৮১৮৬৭৪৮৬২, ই-মেইল: newaz.usso@gmail.com

National Tribune

সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন

যোগাযোগ: +880244809006

ই-মেইল: nationaltribune24@gmail.com

ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭

আমাদের সঙ্গে থাকুন

© 2025 National Tribune All Rights Reserved.