প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যুদ্ধে অর্থ ব্যয় না করে সেই টাকা জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় খরচ করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপশন প্ল্যান (ন্যাপ) এক্সপো-২০২৪’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, "যুদ্ধে অস্ত্র এবং অর্থ ব্যয় না করে সেই টাকাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে যদি ব্যয় করা হত তো বিশ্বটা রক্ষা পেত।"
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার সেই ১৯৭২ সালেই ‘বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন’ বলে মন্তব্য করেন তার মেয়ে শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করেছিলেন। দেশের উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য তিনি ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই ন্যাশনাল হারবেরিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর সার্মথ্য অর্জনে তিনি বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।“
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই নিজস্ব সম্পদ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
“অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০০৯ সালে আমরা নিজস্ব অর্থায়নে 'বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড' প্রতিষ্ঠা করেছি। এর আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৯৬৯টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।”
সামুদ্রিক বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার, উপকূলীয় বনায়ন ইত্যাদি কর্মসূচিতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার তথ্য অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং গত বছরের ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র ক্ষয়ক্ষতির পার্থক্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “ওই সময়ে (১৯৭০) প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু মোখায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। এটি জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বাংলাদেশের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।“
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত দেড় দশকে পার্বত্য ও শাল বনাঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৫৪৮ হেক্টর এলাকায় বৃক্ষরোপণসহ ৮৯ হাজার ৮৫৩ হেক্টর উপকূলীয় বন সৃজন করা হয়েছে।
সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারসমূহের জন্য কক্সবাজার জেলায় আমরা বিশ্বের বৃহত্তম ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প' নির্মাণ করেছি। এ প্রকল্পের আওতায় ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তু, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভূমিহীন, গৃহহীন, সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে জমিসহ ঘর প্রদান করেছি এবং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৪২ লাখ মানুষকে পুনর্বাসন করেছি।“
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান ০.৪৮ শতাংশের কম হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের মধ্যে ‘বাংলাদেশ অন্যতম’।
“অব্যাহত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১২-১৭%, এ শতাব্দীর শেষ দিকে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।“
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি (প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায়) ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমিত রাখতে উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে ইনটেনডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশনস (আইএনডিসি)) প্রণয়ন করে এবং ২০২১ সালে তা হালনাগাদ করে ইউএনএফসিসিতে জমা দেয়। এতে আমরা শর্তহীন ৬.৭৩% এবং শর্তযুক্ত ১৫.১২% গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি যাতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস পায়। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন এবং গ্রামাঞ্চলে ৪৫ লাখের বেশি উন্নত চুলা বিতরণ করা হয়েছে।“
গত বছরে প্রণয়ন করা ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ (এমসিপিপি) এর কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “এমসিপিপিতে অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণের স্বপ্রণোদিত অংশগ্রহণ, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান ও সমাজের সকলের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।"
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, "বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) ২০২২-২০৫০ প্রণয়ন করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এটি ইউএনএফসিসিতে দাখিল করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় আমরা ১১টি জলবায়ু ঝুঁকিযুক্ত এলাকায় ৮টি খাতে ১১৩টি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম চিহ্নিত করেছি।“
নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সহিষ্ণুতা শক্তিশালী করা এবং ঝুঁকি হ্রাসে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
প্রথমত, প্রধান কার্বন-নির্গমনকারী দেশগুলিকে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে তাদের নির্গমন হ্রাস করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু তহবিলে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি উন্নত দেশগুলোর পূরণ করতে হবে। অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে তা সমানভাবে বণ্টন করতে হবে।
তৃতীয়ত, উন্নত দেশগুলিকে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে প্রযুক্তি স্থানান্তরের পাশাপাশি সবচেয়ে কার্যকর জ্বালানি সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
চতুর্থত, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের সময় সংশ্লিষ্ট দেশগুলির উন্নয়ন অগ্রাধিকারগুলো তাদের ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
পঞ্চমত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী-ভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সকল দেশকে ভাগ করে নিতে হবে।
সবশেষে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী সবার সঙ্গে কাজ করতে হবে প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে।
বিষয় : জলবায়ুর পরিবর্তন যুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh