জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। কমিশন তার অনুসন্ধানে জানিয়েছে, এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলগতভাবে জড়িত এবং এর মূল সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস।

রোববার (৩০ নভেম্বর) জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান এবং অন্যান্য সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন, মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুর রহমান বীর প্রতীক (অব.), মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ (অব.), ড. এম. আকবর আলী (অব.), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।

কমিশন প্রধান ফজলুর রহমান জানান, তদন্তকাজ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রাখা হয়েছে। বহু আলামত ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং সম্পৃক্ত অনেকের বিদেশে চলে যাওয়ার মতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার তদন্তের মূল ফাইন্ডিংস তুলে ধরেন:

• পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড: এই হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত।

• আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা: তদন্তে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণ মিলেছে।

• মূল সমন্বয়ক: তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস এই ঘটনা সংঘটিত করার ক্ষেত্রে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন।

• স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভূমিকা: হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের রক্ষা করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। তারা ২০-২৫ জনের একটি মিছিল নিয়ে পিলখানায় ঢুকেছিল এবং বের হওয়ার সময় সেই মিছিলে দুই শতাধিক মানুষ ছিল।

• প্রধানমন্ত্রীর 'গ্রিন সিগন্যাল': পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল।

• দায় নিরূপণ: ঘটনার দায় তৎকালীন সরকার প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) থেকে শুরু করে তৎকালীন সেনাপ্রধানেরও। এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

• গোয়েন্দা ব্যর্থতা: পুলিশ, র‍্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতা ছিল।

• মিডিয়ার অপেশাদারিত্ব: ঘটনার সময় কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং কয়েকজন সাংবাদিকের ভূমিকা ছিল অপেশাদার।

• তথ্য সংরক্ষণ না করা: হত্যাকাণ্ডের সময় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) যেসব বিডিআর সদস্যের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেছিলেন, তাদের সঠিক নাম, পরিচয় ও তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি।

প্রতিবেদন গ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতি দীর্ঘদিন অন্ধকারে ছিল। তিনি সত্য উদঘাটনে কমিশনের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, "ইতিহাসের এই ভয়াবহতম ঘটনা নিয়ে জাতির অনেক প্রশ্ন ছিল, এই কাজের মধ্য দিয়ে সেসব প্রশ্নের অবসান ঘটবে। এই প্রতিবেদনে শিক্ষণীয় বহু বিষয় এসেছে। জাতির জন্য মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে এটি।"

কমিশন তাদের প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে বাহিনীগুলোতে এই ধরনের ঘটনা এড়াতে এবং ঘটনার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য বেশকিছু সুপারিশ করেছে।

এসময় বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ সহকারী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হাফিজ এবং স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি।