অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ছবি: সংগৃহীত
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, পাহাড়ে সহিংসতা ঘটলে সব সরকারের অস্বীকারের ধারা একই—কখনোই তদন্ত হয় না, কারণ এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতারা জড়িত থাকে।
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর ) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে 'সহিংসতার কালক্রম: রামু বৌদ্ধমন্দির হামলা থেকে ১৩ বছর এবং গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশের সহিংসতা' শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
সরকারের সমালোচনা করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ২০১২ সালে রামু হামলার সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাটিকে জামায়াত-বিএনপির ষড়যন্ত্র বলেছিলেন, যেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের চেষ্টা ব্যাহত হয়। একইভাবে, আজ যখন খাগড়াছড়ি জ্বলছে, বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন এটি 'মেড ইন ইন্ডিয়া'।
এই অর্থনীতিবিদের মতে, এই অস্বীকারের ধারা একই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, "তারা কখনোই তদন্ত করে না, কারণ প্রায়শই এতে তাদের নিজেদের স্থানীয় নেতা জড়িত থাকে।"
তিনি আরও বলেন, "সহিংসতা কখনো স্বতঃস্ফূর্ত নয়, বরং তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থে পরিকল্পিত হয়।" ২০১২ সালের রামু হামলার উদাহরণ টেনে তিনি উল্লেখ করেন, "বাঙালি ও মুসলিমদের স্বার্থের নামে সংঘটিত সহিংসতা প্রকৃত অর্থে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে উসকানি এবং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে পরিচালিত হয়।"
অধ্যাপক মুহাম্মদ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "অনেক মামলা হয়েছিল, কিন্তু এর মাত্র একটি অংশেই ন্যায়বিচার হয়েছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে আমরা পিছিয়ে গেছি।"
পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তিনি বলেন, "সহিংসতা বন্ধ করতে রাজনৈতিক ইচ্ছা প্রয়োজন, প্রশাসনিক আদেশ নয়।" তিনি সরকারের প্রতি পার্বত্য অঞ্চলের ভূমির অধিকার বিষয়ে স্বচ্ছতা দাবি করেন।
আনু মুহাম্মদ প্রশ্ন করেন, "যদি সরকার সত্যিই পাহাড়ে শান্তি চায়, তাহলে জমি কার কাছে লিজে দেওয়া হয়েছে তার তালিকা প্রকাশ করুক।" তিনি আরও যোগ করেন, "স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধারা এমন দেশে চাননি, যেখানে মানুষ তার পরিচয়ের কারণে ভয়ে থাকে।"
আলোচনা সভায় উপস্থিত অন্যান্য বক্তারাও সহিংসতার ঘটনায় বিচারহীনতা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং এর ভয়াবহ সামাজিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া রামু হামলার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, "রামু হামলার ১৩ বছর পরও ১৯টি মামলার বেশিরভাগেরই তদন্ত শেষ হয়নি।" তিনি জানান, রামুর ঘটনায় স্থানীয়রা ভিডিও প্রমাণ জমা দিয়েছিলেন, যেখানে দেখা যায় সেনা ও বিজিবি সদস্যদের পাশ কাটিয়ে হামলাকারীরা অগ্নিসংযোগ করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, "একটি কুরিয়ার পোস্টের ভিত্তিতে সহিংসতার ঘটনা সৃষ্টি করা হয়েছে। একই প্যাটার্ন পরবর্তীতে কুমিল্লা, রংপুর, সাতক্ষীরা ও অন্যান্য এলাকায় দেখা গেছে।" তার মতে, "সহিংসতা শুধু সাধারণ মানুষের কাজ নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও সদস্যরা সরবরাহ-সহায়তা দিয়ে চালিয়ে দেয়।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমিনা লুৎফা বলেন, রামুর ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সহিংসতার প্যাটার্ন একই—এর পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, "একটি ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে যেখানে মত-বৈচিত্র্যই ঘৃণার ভিত্তি হয়ে উঠছে। এটি নতুন ধরনের ফ্যাসিজমের দিকে ধাবিত করছে।"
কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল কাফি রতন বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও দেশে কোনো সরকার গণতান্ত্রিকভাবে শাসন করেনি। চলমান সহিংসতা ধর্মীয় ফ্যাসিজমের উদাহরণ এবং বর্তমান শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা রক্ষায় মনোযোগী। তিনি তার পরবর্তী সংগ্রামের লক্ষ্য হিসেবে "শ্রমিক, কৃষক, সংখ্যালঘু, দলিত ও সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকারদের এক রেইনবো কোয়ালিশন" তৈরির কথা বলেন, যার মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জিত হবে।
গায়ক ও লেখক অরূপ রাহী মনে করেন, রামু থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত সহিংসতার ঘটনা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত না থাকা, ডানপন্থি রাজনৈতিক মতাদর্শের মিশ্রণ, মিথ্যাচার ও প্রপাগান্ডার কারণে ঘটছে। তিনি পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করে "গভীর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র" গড়ে তোলার পক্ষে মত দেন।
আলোচনা সভাটি পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু।
বিষয় : সহিংসতা খাগড়াছড়ি আনু মুহাম্মদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh