ছবি: সংগৃহীত
বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রতিদিনই থাকতো উপচে পড়া ভিড় মাত্র কয়েকদিন আগে শেষ হলো অমর একুশে বইমেলার এবারের আয়োজন। এবারের মেলা চলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমির প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায়। মাসব্যাপী এ মেলায় আসেন প্রায় ৬০ লাখ ক্রেতা ও দর্শনার্থী। তবে আগামী বছর এই স্থানে বইমেলা আয়োজন নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। এনিয়ে উদ্বিগ্ন লেখক, প্রকাশক ও পাঠকরা।
বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের বইমেলার স্থান নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল। কারণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরির কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীসময়ে জানানো হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উন্নয়নকাজ শুরু হবে ২০২৪ সালের মার্চ থেকে। ফলে এ বছর এখানে বইমেলা আয়োজনের সুযোগ পায় মেলা কমিটি। তবে এ বছরের মেলা শেষ না হতেই গুঞ্জন শুরু হয় ২০২৫ সালের মেলার ভেন্যু নিয়ে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ তৃতীয় প্রকল্পের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রদত্ত ভাষণের স্থান সংরক্ষণসহ আনুষঙ্গিক উন্নয়নকাজ হবে। এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
বইমেলা তো বিভিন্ন পণ্যভিত্তিক বা বাণিজ্যমেলা নয়। বর্তমানে বইমেলার ভেন্যুর সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের ঐতিহ্যের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। তাই একুশে বইমেলার স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা একাডেমি এলাকার একটা তাৎপর্য আছে।
ঢাকা গণপূর্ত মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নাছিম খান বলেন, ‘যতদূর জানি, আগামী বছর থেকে মেলা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রকল্প অনুযায়ী এখানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) কাজ চলবে। বাকিটা সংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্ত।’
এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিটি ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাজ আমরা শুরু করেছি। এখন আগামী বছর থেকে মেলা হবে কি হবে না, সেটা তো জানি না। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।’
আমাদের ভাষাপ্রেম ও বইমেলা জায়গা পরিবর্তন করলে ঐতিহ্য হারাবে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণে মেলা নিয়ে যা বললেন বাংলা একাডেমির ডিজি।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘এই মাঠে যেসব ভাস্কর্য নির্মাণ হবে সেগুলোর কাজ আমি করবো। তবে মাঠজুড়ে কী কী কাজ হবে, মাঠ খালি থাকবে কি না- সেটা তো মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় জানে।’
এদিকে, বইমেলার ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে স্থান পরিবর্তন না করার দাবিতে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি (বাপুস)। তারা বলেন, স্থান পরিবর্তন হলে ঐতিহ্য হারাবে বইমেলা। এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে অতি সহজেই বাঙালির গৌরবের ইতিহাস অনেকাংশে ম্লান করে দেওয়া হবে। এটা হবে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, গবেষক, লেখক, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার মানুষকে সাংস্কৃতিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতি করার শামিল। আমাদের একমাত্র দাবি, অমর একুশে বইমেলা বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যাবে না।
মেলার ভেন্যু পরিবর্তনের বিপক্ষে পাঠকরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রাজিব বলেন, ‘আমি মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢামেক, শাহবাগ এলাকা খুবই প্রাণবন্ত একটা জায়গা। টিএসসিতে শুধু শিক্ষার্থীরা না, এখানে যে পাবলিক স্ফেয়ার (নাগরিকরা যেখানে একত্রিত হয়ে নিজেদের মতামত বিনিময় করেন) এবং যে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা হয় এটা অন্য কোথাও হয় না। এই পরিবেশ তো পূর্বাচলে পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় এ স্থানের ঐতিহ্য। পূর্বাচলে মেলা গেলে ওখানে বই কিনতে কেউ যাবে না, সবাই অনলাইনে কিনবে। আমি মনে করি উদ্যান না হলেও যদি এই এলাকায় রাখা যায়, তাহলে মেলার আবহ টিকে থাকবে।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা আশপাশের এলাকাটা হলো আমাদের কালচারাল হাব। মানুষ আসলে বইমেলা বলতে এই স্থানকে বোঝে। পাঠকদের আবেগটা এখানে। এই এলাকা ছেড়ে বইমেলা যদি অন্য কোথাও হয়, তাহলে মেলা নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে।
জনপ্রিয় লেখক ও অনুবাদক জাভেদ হুসেন বলেন, ‘বইমেলা তো বিভিন্ন পণ্যভিত্তিক বা বাণিজ্যমেলা নয়। বর্তমানে বইমেলার ভেন্যুর সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের ঐতিহ্যের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। তাই একুশে বইমেলার স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা একাডেমি এলাকার একটা তাৎপর্য আছে। ভেন্যু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয় ভেবে দেখা দরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় বইমেলার ভেন্যু পরিবর্তন যুক্তিযুক্ত হবে না। বাংলা একাডেমিতে যদি মেলা ফিরে যায়, সেখানে আবার জায়গার সংকট হবে। তবে মেলা স্থানান্তর ঠিক হবে না। মেলার বর্তমান ভেন্যুতে যেভাবে প্রচুর প্রকাশনী ও পাঠকের অংশগ্রহণ হচ্ছে, এখানে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।’
আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা এই এলাকা থেকে কোথাও যাবে না। এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যদি মেলা করতে না দেওয়া হয় তাহলে বাংলা একাডেমিতে হবে। এর বাইরে অন্য কোথাও বা পূর্বাচলে হলে এটা অন্য মেলা হবে, বইমেলা নয়। কারণ, একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলা একাডেমি। এখানে হয়তো প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে উদ্যানের কিছু অংশ রাখতে পারেন। নাহলে বাংলা একাডেমি ও একাডেমির সামনের রাস্তা রয়েছে। সেখানে মেলা হবে। এক্ষেত্রে স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রকাশনী কম হবে। এত এত প্রকাশনী না রেখে প্রকৃত প্রকাশকরা মেলায় সুযোগ পাক।’
বিষয় : অমর একুশে বই মেলা ২০২৫ সালের বই মেলা
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh