এডভোকেট আসিফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।
আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়াটি কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরীক্ষা নয়, এটি ভবিষ্যতের বিচারকক্ষে প্রার্থীর পেশাগত বিচক্ষণতা, নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাসের একটি বহুস্তরীয় মূল্যায়ন। লিখিত পরীক্ষার কঠিন ধাপ পেরোনোর পর প্রার্থীরা যখন মৌখিক পরীক্ষা বা 'ভাইভা' বোর্ডের মুখোমুখি হন, তখন বুঝতে হবে—এটিই আইন পেশার মূল স্রোতে প্রবেশের চূড়ান্ত দুয়ার। এই পরীক্ষায় বোর্ড শুধু আইনের ধারার মুখস্থ জ্ঞান দেখতে চায় না, বরং একজন প্রার্থী আদালতের বাস্তব পরিবেশে কতটা দক্ষ ও নীতিবান অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করার উপযুক্ত, সেটাই যাচাই করে।
বিচারক, অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেট ও স্বনামধন্য আইন শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত হয়। তাঁদের প্রত্যাশা অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। একজন প্রার্থীর মধ্যে তাঁরা মূলত তিনটি প্রধান গুণাবলির প্রতিফলন খোঁজেন:
আইনজীবীর জন্য প্রশাসনিক শৃঙ্খলা একটি মৌলিক গুণ। ভাইভার দিনে প্রার্থীদের অবশ্যই প্রবেশপত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার মূল সনদ ও মার্কশীটসহ কেইস-ডায়েরি সঙ্গে রাখতে হবে। বার কাউন্সিল সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এসব নথি উপস্থাপনে ব্যর্থ হলে তালিকাভুক্তির ফলাফল অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হতে পারে। এই প্রশাসনিক সতর্কতা দেখায়, পেশাগত জীবনে প্রতিটি নথির গুরুত্ব অপরিসীম।
কেইস-ডায়েরি
শিক্ষানবিশকালীন (Pupilage) অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয় কেইস-ডায়েরিতে। এতে মামলার নাম, তারিখ, কোর্ট, শুনানির সারসংক্ষেপ এবং প্রয়োগিত ধারাগুলোর বিস্তারিত উল্লেখ থাকা চাই। বোর্ড প্রায়শই ডায়েরি থেকে একটি নির্দিষ্ট মামলা বেছে নিয়ে এর আইনি প্রেক্ষাপট জানতে চায়। ধরুন, যদি জামিনের আবেদন সংক্রান্ত কোনো কেস থাকে, তবে CrPC-এর ৪৯৬ বা ৪৯৭ ধারার প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই পরীক্ষার্থীর উচিত অন্তত ১০টি গুরুত্বপূর্ণ মামলা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে প্রস্তুত থাকা।
পোশাকে মর্যাদা, আচরণে শালীনতা
ভাইভা বোর্ডে প্রার্থীর উপস্থিতি হতে হবে পেশাগত মর্যাদার প্রতীক। বাধ্যতামূলকভাবে কালো কোট ও কালো টাই পরিধান করতে হবে। এটি শুধু একটি ড্রেস কোড নয়, এটি আইন পেশার প্রতি সম্মান ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। প্রার্থীর দেহভঙ্গি ও কথোপকথনে শালীনতা ও আত্মবিশ্বাস বজায় রাখা আবশ্যক।
ভাইভার জন্য প্রস্তুতিতে কিছু মূল আইনি বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে:
সংবিধান: মৌলিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৭, ২৯, ৪৩) এবং রিট আবেদনের মাধ্যমে অধিকার বলবৎ করার পদ্ধতি (অনুচ্ছেদ ৪৪) সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখা জরুরি।
দেওয়ানি কার্যবিধি (CPC): ধারা ৯, ১১, ১৫, ২০ এবং অর্ডার I, VI, IX, XXXIX। বিশেষত, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার তিনটি শর্ত (Prima Facie Case, Balance of Convenience, Irreparable Loss) এর প্রয়োগ ভালোভাবে জানতে হবে।
ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC): আমলযোগ্য ও অ-আমলযোগ্য অপরাধের পার্থক্য, জামিন (ধারা ৪৯৬–৪৯৭) এবং আগাম জামিনের আইনি ভিত্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অপরিহার্য।
সাক্ষ্য আইন: প্রাসঙ্গিকতা (ধারা ৬–১৬), মৃত্যুশয্যাকালীন ঘোষণা, স্বীকারোক্তি এবং হেয়ারসে রুল ও বেস্ট এভিডেন্স রুল—এগুলো ভাইভার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
নৈতিকতার পরীক্ষা: 'বার কাউন্সিল অর্ডার, ১৯৭২' অনুযায়ী, অ্যাডভোকেটদের আচরণবিধি ও শৃঙ্খলাভঙ্গের ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে হবে। মিথ্যা তথ্য দেওয়া ক্লায়েন্টের ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেটের কর্তব্য কী, এমন নৈতিক প্রশ্ন এলে দৃঢ়ভাবে বলতে হবে: আদালতের প্রতি দায়িত্বই সর্বাগ্রে।
ভাইভা সাধারণত মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিট স্থায়ী হয়। তাই উত্তর হতে হবে সংক্ষিপ্ত, সরাসরি ও প্রাসঙ্গিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যদি কোনো প্রশ্ন অজানা থাকে, তবে উত্তর অনুমান না করে বিনয়ের সঙ্গে তা স্বীকার করে নেওয়া। এই সততা পেশাগত বিশ্বাসের পরিচায়ক।
বার কাউন্সিলের মৌখিক পরীক্ষা কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি আইন পেশায় আপনার মান ও নৈতিকতা নির্ধারণের মাপকাঠি। আইনি জ্ঞান, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও পেশাগত নৈতিকতা—এই তিনের সমন্বিত প্রস্তুতিই নিশ্চিত করবে একজন প্রার্থী শুধু তালিকাভুক্তই হবেন না, বরং একজন দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী আইনজীবী হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন সফলভাবে শুরু করতে পারবেন।
এডভোকেট: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
বিষয় : বাংলাদেশ বার কাউন্সিল
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
