দিল্লির লালকেল্লার কাছে গাড়ি বিস্ফোরণ স্থলে কাজ করছেন ফরেনসিক দলের সদস্য। ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির একটি জনাকীর্ণ সড়কে ভয়াবহ গাড়ি বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এই হামলার পর থেকেই ভারতে ইসলামবিদ্বেষ এবং কাশ্মীরবিরোধী মনোভাবের এক নতুন ঢেউ তৈরি হয়েছে। তদন্তে নেমে ভারতীয় পুলিশ কাশ্মীরের চিকিৎসক ও ইসলামী চিন্তাবিদসহ একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম) এবং আনসার গাজওয়াত-উল-হিন্দ (এজিইউএইচ)-এর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
দিল্লিতে বিস্ফোরণের ২৬ দিন আগে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরতলির নওগামে একটি সবুজ শিরোনামযুক্ত প্যাম্ফলেট দেখা গিয়েছিল। ভাঙা উর্দুতে লেখা ওই পোস্টারে পাকিস্তানভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদের নাম উল্লেখ করা হয় এবং এটি ওই সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে দাবি করা হয়।
প্যাম্ফলেটের ভাষা ছিল স্পষ্টত হুমকির। সেখানে কাশ্মীরে অবস্থানরত ভারতীয় সরকারি বাহিনী এবং যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সেই স্থানীয় জনগণের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। শ্রীনগর ও জম্মুর মধ্যবর্তী মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী দোকানদারদেরও সরকারি বাহিনীকে আশ্রয় না দেওয়ার কঠোর পরিণতি ভোগ করার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
একসময় কাশ্মীরে এ ধরনের সতর্কবার্তা সাধারণ ঘটনা ছিল, বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশক এবং ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে যখন বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলন তুঙ্গে ছিল। তবে ২০১৯ সালের আগস্টে ভারত সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল ও রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করার পর সশস্ত্র সহিংসতা কমে যাওয়ায় এমন পোস্টার দেখা যাওয়া বিরল হয়ে উঠেছিল। সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সশস্ত্র হামলার সংখ্যা ছিল ৫৯৭, যা ২০২৫ সালে ১৪৫-এ নেমে আসে।
নওগামের প্যাম্ফলেট প্রকাশের সূত্র ধরে তিন সপ্তাহ ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে আটক করেন। এদের মধ্যে দক্ষিণ কাশ্মীরের সোপিয়ান জেলার এক ইসলামী চিন্তাবিদ ইরফান আহমেদ (২৪) এবং কুলগামের বাসিন্দা আদিল রাঠোর-এর নাম উঠে আসে। রাঠোরকে পরে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ তার লকার থেকে একটি অ্যাসল্ট রাইফেল উদ্ধার করার দাবি করেছে।
রাঠোরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরেক সহযোগী কাশ্মীরি চিকিৎসক মুজাম্মিল শাকিল গণাই-এর নাম বেরিয়ে আসে, যিনি দিল্লির কাছে ফরিদাবাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। পুলিশের দাবি, ফরিদাবাদে গণাইয়ের নামে ভাড়া নেওয়া দুটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তারা ২,৯০০ কেজি দাহ্য রাসায়নিক ও অস্ত্র উদ্ধার করেছে।
কাশ্মীর পুলিশ এ গ্রেপ্তার অভিযানকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক’ উন্মোচন হিসেবে দাবি করেছে, যা জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার গাজওয়াত-উল-হিন্দ (এজিইউএইচ)-এর সঙ্গে যুক্ত।
তদন্ত চলার মধ্যেই চিকিৎসকেরা গণাই ও রাঠোর, ইসলামী চিন্তাবিদ ইরফান আহমেদ এবং আরও চারজনসহ মোট সাতজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ বিবৃতিতে জানানো হয়। এই চারজনের মধ্যে উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌ শহরের এক নারীও রয়েছেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা এই সূত্র ধরেই আরেক কাশ্মীরি চিকিৎসক উমর নবী-র বিষয়ে তথ্য পান। তবে নবীকে গ্রেপ্তার করার আগেই গত সোমবার নয়াদিল্লিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তদন্তকারীরা বলছেন, ২৯ বছর বয়সী চিকিৎসক উমর নবীই বিস্ফোরকভর্তি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন।
পুলিশের প্রকাশ করা সিসিটিভির ফুটেজে কালো মুখোশ পরা এক তরুণকে একটি গাড়ি নিয়ে দিল্লির টোল বুথ পার হতে দেখা যায় এবং পরে যানজটে ভরা চৌরাস্তায় বিস্ফোরণের হলুদ আলোর ঝলকানি ধরা পড়ে।
বিস্ফোরণের পর দেশব্যাপী নিরাপত্তা সতর্কতা জারি হয় এবং কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। শুধুমাত্র দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাম জেলাতেই নিরাপত্তা বাহিনী ৪০০টি তল্লাশি অভিযান চালায় এবং প্রায় ৫০০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে।
এই ঘটনার তদন্ত চলাকালীনই ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামবিদ্বেষ ও কাশ্মীরবিরোধী মনোভাব তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১২ নভেম্বর গুরুগাঁও পুলিশ হাউজিং সোসাইটিগুলোকে কাশ্মীরি বাসিন্দাদের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিলে তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়া হচ্ছে। কাশ্মীরি ছাত্র এবং অধিকারকর্মী নাসির খুয়েহামি জানিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কাশ্মীরি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে এবং তাদের প্রধান উদ্বেগ এখন নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নয়াদিল্লির বিস্ফোরণ এবং এর তদন্ত কাশ্মীর ও সশস্ত্র গোষ্ঠী মোকাবিলায় ভারতের নীতি নিয়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
বিষয় : ভারত সন্ত্রাসী হামলা জঙ্গি হামলা বিস্ফোরণ দিল্লি হামলা
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh
