মারিয়া কোরিনা মাচাদো। ছবি: রয়টার্স
ভেনেজুয়েলায় বাড়তে থাকা কর্তৃত্ববাদের মুখে প্রতিরোধ ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠা মারিয়া কোরিনা মাচাদো এবছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। ৫৮ বছর বয়সী এই নির্ভীক কর্মী দেশের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। জনগণের কাছে তিনি 'রক-স্টার' জনপ্রিয় এবং ভেনেজুয়েলার ‘লৌহ মানবী’ হিসেবেও পরিচিত।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের এই সিদ্ধান্তকে ভেনেজুয়েলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক স্বীকৃতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বারবার দমন-পীড়নের শিকার হয়েও মাচাদো হাল ছাড়েননি। দশকজুড়ে তিনি কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য লড়াই করে গেছেন, অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও গণতন্ত্রের শিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন।
শুক্রবার নরওয়ের অসলোতে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ইয়রগেন ওয়াটনে ফ্রিডনেস মারিয়া কোরিনা মাচাদোর নাম ঘোষণার শুরুতেই বলেন, "এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে একজন সাহসী এবং নিবেদিতপ্রাণ শান্তির চ্যাম্পিয়নকে, একজন নারীকে যিনি অন্ধকারেও গণতন্ত্রের আলো জ্বলিয়ে রেখেছেন।"
নোবেল কমিটির তথ্যানুযায়ী, আলফ্রেড নোবেলের উইলে উল্লেখিত শান্তি পুরস্কারের তিনটি শর্তই পূরণ করেছেন মাচাদো। তিনি দেশের বিরোধী দলগুলোকে একত্রিত করেছেন, ভেনেজুয়েলার সমাজে সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পক্ষে দৃঢ়ভাবে কাজ করে গেছেন। কমিটি আরও বলেছে, মাচাদো দেখিয়েছেন যে গণতন্ত্র ও শান্তির পথ অভিন্ন। তিনি এমন এক ভবিষ্যতের আশা জাগিয়েছেন, যেখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং তারা শান্তিতে বাঁচার স্বাধীনতা পাবে।
চেয়ারম্যান ফ্রিডনেস মাচাদোকে লাতিন আমেরিকায় সাহসিকতার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তিনি গুরুত্বপূর্ণ ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছেন। আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হওয়া এবং জীবনের ওপর গুরুতর হুমকির পরও দেশে থেকে তার এই সিদ্ধান্ত লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে।
মারিয়া কোরিনা মাচাদোর জন্ম ভেনেজুয়েলার কারাকাসে ৭ অক্টোবর, ১৯৬৭ সালে। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অর্থনীতিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর ১৯৯২ সালে তিনি এতিম ও পথশিশুদের জন্য ‘এটেনা ফাউন্ডেশন’ খোলেন। ২০০২ সালে তিনি ‘সুমাত’ নামে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রচার চালানো একটি ভোট পর্যবেক্ষণ সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা হন। এই সংগঠনের মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর রাজনৈতিক পদার্পণ ঘটে।
২০১০ সালে তিনি রেকর্ড সংখ্যক ভোটে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রশাসন তাঁকে পদচ্যুত করে। পরবর্তীতে তিনি উদার রাজনৈতিক দল ‘ভেন্টে ভেনেজুয়েলা’র নেতৃত্ব নেন। এছাড়াও তিনি বিভক্ত গণতন্ত্রপন্থি দলগুলোকে একত্রিত করার লক্ষ্যে ‘সয় ভেনেজুয়েলা অ্যালায়েন্স’ গড়তে সহায়তা করেন।
২০২৩ সালে বিরোধীদলীয় প্রাইমারি নির্বাচনে ৯২ শতাংশ ভোটে বিশাল জয় পেয়ে মাচাদো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পথে ছিলেন। তবে আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি ২০২৪ সালের জুলাইয়ের নির্বাচনে নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে লড়তে পারেননি। ফলে তিনি বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে এডমান্ডো গঞ্জালেস উরুতিয়াকে সমর্থন দেন এবং তাঁর পক্ষে প্রচার চালান।
নির্বাচনের ফল নিয়ে ব্যাপক বিরোধ ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে। ফলাফল বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং সরকার কঠোর হাতে তা দমন করে। জীবনের ঝুঁকি থাকায় বিরোধী নেতা গঞ্জালেস দেশ ছাড়েন। মারিয়া কোরিনা মাচাদোকেও আত্মগোপনে যেতে হয়।
তবুও তাঁকে দমানো যায়নি। নির্যাতন, নিষেধাজ্ঞা ও হুমকির মুখেও মাচাদো তাঁর লড়াই থামাননি। নিভৃতে থেকেও তিনি কেবল স্বাধীন নির্বাচনের দাবিই নয়, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোও তুলে ধরছেন। গণতন্ত্রের নৈতিক কণ্ঠস্বর হিসেবে তিনি এখনো কারাকাসের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে গেছেন। এ বছর তাঁকে 'টাইম' ম্যাগাজিন ২০২৫ সালের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় রেখেছে।
শান্তি পুরস্কার পেয়ে মাচাদো তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। দলের এডমুন্ডো গঞ্জালেসকে পাঠানো একটি ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, "আমি হতবাক! এটা কি হলো! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।"
মাচাদো গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ মানবাধিকার সম্মাননা শাখারভ পুরস্কার পেয়েছিলেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি এই পুরস্কারজয়ী ২০তম নারী হলেন। তিনি উদার অর্থনৈতিক সংস্কার এবং গরিব নাগরিকদের সহায়তার জন্য কল্যাণ প্রকল্প গঠনের পক্ষে কথা বলে আসছেন।
বিষয় : প্রদীপ গণতন্ত্র মারিয়া কোরিয়া মাচাদো
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh