বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স
গাজায় ভয়াবহ সংঘাতের জেরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েল যখন ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, তখন তারা আফ্রিকা মহাদেশে নিজেদের পুরোনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে এবং নতুন মিত্র খুঁজতে মরিয়া। বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রভাব খর্ব ও জাতিসংঘে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যেই এই তৎপরতা বাড়িয়েছে নেতানিয়াহু সরকার।
সম্প্রতি জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় ৫২ বছর পর ইসরায়েলি দূতাবাস পুনরায় চালু হওয়া এই কূটনৈতিক তৎপরতার কেন্দ্রে চলে এসেছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডন সার দূতাবাস উদ্বোধন করে দাবি করেছেন, "জাম্বিয়ায় ফিরছে ইসরায়েল, আফ্রিকায় ফিরছে ইসরায়েল।" তিনি আরও দাবি করেন, আফ্রিকার অনেক দেশই এখন ইসরায়েলের দূতাবাস খোলার জন্য আগ্রহী, তবে জাম্বিয়া দিয়েই এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
গাজায় চলমান সহিংসতার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েল কোণঠাসা হওয়ায় এই পদক্ষেপকে নেতানিয়াহু সরকার একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফ্রিকায় ইসরায়েলের নতুন করে সক্রিয় হওয়ার মূল লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিনের কট্টর সমর্থক দক্ষিণ আফ্রিকার প্রভাব খর্ব করা। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার অভিযোগ এনেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
এর মোকাবিলায়, ইসরায়েল জাম্বিয়া বা দক্ষিণ সুদানের মতো দেশকে পাশে টেনে একধরনের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' (ভাগ করো ও শাসন করো) কৌশল প্রয়োগ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জাম্বিয়ায় দূতাবাস উদ্বোধনের আগে ইসরায়েলের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল আফ্রিকা সফরে যান, যার মধ্যে ছিল ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল নাইজেরিয়া।
নাইজেরিয়া সফরের পরপরই দেশটির সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট ফিলিস্তিনি কমিউনিটির নেতা রামজি আবু ইব্রাহিমকে আটক করে। যদিও তার আটকের সঙ্গে ইসরায়েলি মন্ত্রীর সফরের কোনো যোগসূত্র স্পষ্ট নয়, বিষয়টি আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
এরপর হাসকেল যান ঘনিষ্ঠ মিত্র সাউথ সুদানে। সেখানকার নাজুক পরিস্থিতিতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
আলোচনার কেন্দ্রে আসে আরেকটি স্পর্শকাতর বিষয়। হাসকেলের সফরের সময়ই ফাঁস হয়— গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক সাউথ সুদানে স্থানান্তরের বিতর্কিত পরিকল্পনা নিয়ে ইসরায়েল ও সাউথ সুদান কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে।
জাতিগত নিধনের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তরকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও, সাউথ সুদান এ বিষয়ে মুখ খোলেনি।
একই আলোচনা চলছে সোমালিল্যান্ডকে নিয়েও। সোমালিল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বিনিময়ে গাজা থেকে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের বসতি স্থাপনের প্রস্তাবের কথা উঠে আসে। তবে সোমালিল্যান্ডের বাসিন্দারা এমন কোনো উদ্যোগে অংশ নিতে স্পষ্টতই অনিচ্ছুক বলে জানিয়েছেন।
আফ্রিকার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের ইতিহাস বেশ জটিল। গবেষকদের মতে, আফ্রিকান দেশগুলো ইসরায়েল থেকে দূরত্ব বজায় রাখার সবচেয়ে বড় কারণ হলো 'ফিলিস্তিন ইস্যু'। বর্ণবৈষম্যের শিকার দক্ষিণ আফ্রিকা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একই ধরনের দমননীতির বিরোধিতা করে আসছে। নেলসন ম্যান্ডেলার উক্তি—"দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া অসম্পূর্ণ," আজও তাদের অবস্থান তুলে ধরে।
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়া আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েল ঘনিষ্ঠতা বাড়ালেও, ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। মিশরসহ আফ্রিকার ওপর আগ্রাসন চালানোর দায়ে উগান্ডা প্রথম সম্পর্ক ছিন্ন করে, এবং কয়েক মাসের মধ্যে আরও ২০টির বেশি আফ্রিকান দেশ সম্পর্ক ভেঙে দেয়। এটি ছিল ইসরায়েলের জন্য বড় কূটনৈতিক ধাক্কা।
ইসরায়েল পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর বিশেষ নজর দিচ্ছে। ইসরায়েলের সহায়তা সংস্থা মাশাভ কৃষি, পানি ও স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা পাঠালেও, গবেষণায় দেখা গেছে—সাউথ সুদানই ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের পাশে থেকেছে।
সামরিক সহযোগিতা: ১৯৬০ এর দশক থেকেই ইসরায়েলের মোসাদ সাউথ সুদানের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের প্যানেলও ২০১৬ সালের গৃহযুদ্ধে ইসরায়েলি অস্ত্রের ইন্ধন থাকার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল।
অস্ত্র বাণিজ্য: ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, সাউথ আফ্রিকা, উগান্ডাসহ বেশ কিছু দেশ ইসরায়েল থেকে অস্ত্র কিনেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েল আফ্রিকান নিরাপত্তা কাঠামোতে ঢুকে পড়ে অস্থিরতা থেকে যেমন সুবিধা নিচ্ছে, তেমনি এমন মিত্র তৈরি করছে যারা তাদের সামরিক নৃশংসতার সমালোচনা করবে না।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আফ্রিকা মহাদেশে ইসরায়েলের দুর্বল সমর্থনও প্রায় ভেঙে পড়েছে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েল কূটনৈতিক খেলায় সামান্য হলেও সফল হচ্ছে। গাজায় সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের প্রথম প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা ছয় আফ্রিকান দেশের মধ্যে ছিল জাম্বিয়া ও সাউথ সুদান। বিশ্লেষক ফুরি মনে করেন, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জাম্বিয়ার মতো দেশের মরিয়া পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রভাব বলয়ের ভেতরে আরও গভীরভাবে প্রবেশের চেষ্টা করছে।
জোহানেসবার্গভিত্তিক সংহতি গোষ্ঠী 'আফ্রিকা ফর ফিলিস্তিন'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ দেসাই জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েলের এই 'হতাশাজনক' কৌশল সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের কারণে দুর্বল হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মহাদেশজুড়ে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সংহতি আন্দোলন দ্রুতগতিতে বেড়েছে।
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, "আমরা নিশ্চিত যে যেসব সরকার বা রাজনীতিবিদ বর্তমানে ইসরায়েলের প্রলোভনে আকৃষ্ট হচ্ছেন, জনগণই একদিন তাদের জবাবদিহি করবে। শেষ পর্যন্ত, আফ্রিকান মহাদেশে ইসরায়েলের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।"
বিষয় : ইসরায়েল
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh