জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বক্তব্য দিতে এলে অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান অনেক দেশের প্রতিনিধি। ছবি: এএফপি
ফিলিস্তিনে চলমান আগ্রাসন, আইসিসি-র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, এবং বিশ্বব্যাপী নিন্দার মধ্যেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে তাঁর ভাষণ শুরু হতেই অনেক দেশের প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ জানিয়ে অধিবেশন কক্ষ বর্জন করেন, যা বিশ্বের দরবারে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাকেই স্পষ্ট করে তুলল।
শুক্রবার, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের চতুর্থ দিনে, নেতানিয়াহুর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। আরব ও মুসলিম দেশগুলোসহ আফ্রিকা ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশের প্রতিনিধিরা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন (ওয়াকআউট)। প্রতিনিধিরা যখন বের হচ্ছিলেন, তখন উপস্থিত অনেকের হাততালি ও শিস দেওয়ার শব্দ শোনা যায়।
পরিষদের সভাপতি শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানালেও তাতে কাজ হয়নি। ফলে, নেতানিয়াহু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর সামনের আসনগুলো ফাঁকা দেখা যায়। এই গণবর্জন চলমান গাজা সংকটে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মতৈক্যকে তুলে ধরে।
নেতানিয়াহুর ভাষণ চলাকালীন নিউইয়র্কেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জাতিসংঘ ভবনের কাছে টাইমস স্কয়ারে হাজার হাজার মানুষ গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নিধনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা ও প্ল্যাকার্ড, যাতে লেখা ছিল—‘ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ করুন’, ‘নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করুন’, এবং ‘গাজাকে অনাহারে রাখা এখনই বন্ধ করুন’।
বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের ওয়াকআউটের খবর শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এবং নেতানিয়াহুর ভাষণ শেষে জাতিসংঘ ভবনের দিকে যাত্রা করেন। তবে, একই সময়ে হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে নিউইয়র্কে বিক্ষোভ করেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ইসরায়েলি ও ইহুদিরাও।
এবারের অধিবেশনে গাজা সংকট বড় গুরুত্ব পেয়েছে। অধিবেশন শুরুর আগেই পশ্চিমা ১০টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে বিভিন্ন দেশের নেতারা ইসরায়েলের কঠোর নিন্দা জানান। চিলির প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বরিচ জাতিগত নিধনের অভিযোগে নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) তোলার দাবি জানান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গাজায় নিহত শিশু হিন্দ রজবের কথা তুলে ধরে ইসরায়েলি নৃশংসতার নিন্দা করেন।
স্মর্তব্য, ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের অভিযোগে মামলা করেছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নেতানিয়াহুর ভাষণের বড় অংশ জুড়েই ছিল গাজায় চলমান সংঘাত। প্রায় দুই বছর ধরে উপত্যকাটিতে ৬৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যার পরেও তিনি ইসরায়েলের নৃশংসতার পক্ষে সাফাই তুলে ধরেন। তিনি জাতিগত নিধনের অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং হামাসকে বেসামরিক মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য দায়ী করেন।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরের কাছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভাষণের পর বিক্ষোভ করেন ফিলিস্তিনপন্থীরা। ছবি: রয়টার্স
ভাষণে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলার তুলনা করে বলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য রাষ্ট্র দেওয়াটা হবে চরম ভুল সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোরও তিনি সমালোচনা করেন।
নেতানিয়াহু বলেন, গাজায় ইসরায়েলের 'যুদ্ধ' এখনো শেষ হয়ে যায়নি। যেসব দেশ প্রকাশ্যে ইসরায়েলের নিন্দা করেছে, তাদের সমালোচনা করে তিনি দাবি করেন, 'অনেক নেতাই প্রকাশ্যে নিন্দা করেন আর আড়ালে ধন্যবাদ জানান।'
জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর এই ভাষণে গাজায় ইসরায়েল কর্তৃক সংঘটিত জাতিগত নিধন নিয়ে বিশ্বের মানুষের জনমত বদলাবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) যোগাযোগবিষয়ক সাবেক পরিচালক জেভিয়ার আবু ইদ। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, "নেতানিয়াহু এমন ভাষণ দেবেন, তা জানাই ছিল। তিনি একঘরে হয়ে পড়েছেন।"
এদিকে, নেতানিয়াহুর এই সফরের দিনেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই হামলায় শুক্রবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ৪৭ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১১ জন ছিলেন ত্রাণের খাবার সংগ্রহকারী। গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫০০ ছাড়িয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh