যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টার বৈঠকেও ইউক্রেইন যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে সমঝোতা হয়নি বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
তিনি বলেছেন, শুক্রবার আলাস্কায় তাদের বৈঠক ‘খুবই ফলপ্রসূ’ হয়েছে, তবে চূড়ান্ত লক্ষ্যে ‘পৌঁছানো যায়নি’।
পুতিন এ বৈঠককে সংঘাত অবসানের একটি ‘সূচনা বিন্দু’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, তিনিও ‘আন্তরিকভাবে’ সংঘাতের অবসান চান। তবে সংঘাতের ‘মূল কারণগুলো’ দূর করতে হবে।
আঙ্করেজের এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন ঘাঁটিতে জ্যেষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ে দীর্ঘ বৈঠকের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দুই নেতা বলেছেন, কিছু বিষয়ে তাদের অগ্রগতি হয়েছে।
কিন্তু কোন কোন বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে, আর কোন কোন বিষয় অমীমাংসিত, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু তারা বলেননি। সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের কাছ থেকে কোনো প্রশ্নও তারা নেননি।
বৈঠক শেষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ট্রাম্প ও পুতিন যখন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছিলেন, তাদের পেছনে নীল প্রচ্ছদপটে লেখা ছিল ‘শান্তির সন্ধান’।
ট্রাম্প বলেন, “অনেক, অনেক বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। আমি বলব, কয়েকটি বড় বিষয়ে আমরা এখনও পুরোপুরি মতৈক্যে পৌঁছাতে পারিনি, তবে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।”
তার ভাষায়, “চুক্তি তখনই হবে, যখন সমঝোতা হবে।”
রয়টার্স লিখেছে, গত ৮০ বছরের মধ্যে ইউরোপের ভয়াবহতম যে যুদ্ধ ইউক্রেইনে চলছে, তার অবসান ঘটানোই ছিল ট্রাম্পের আলাস্কা বৈঠকের ঘোষিত লক্ষ্য।
তবে বৈঠক শেষে যুদ্ধবিরতির কোনো ঘোষণা আসেনি। এই আলোচনা আদৌ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বিবিসি লিখেছে, ট্রাম্প নিজেকে শান্তির দূত এবং সফল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসেন। তবে সম্ভবত আলাস্কা থেকে এর কোনোটিই তিনি অর্জন করতে পারেননি।
সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেন, “একটি স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আনতে হলে আমাদের সংঘাতের মূল কারণগুলো দূর করতে হবে।”
তবে ‘মূল কারণ’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন, তা ব্যাখ্যা করেননি পুতিন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, ইউক্রেইন ও ইউরোপীয়রা যেন এই শান্তি প্রক্রিয়ায় ‘বাধা সৃষ্টি’ না করে, সেটাই তিনি চান।
তার ভাষায়, ট্রাম্প স্পষ্টতই তার দেশের সমৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত। তবে তিনি এটাও বোঝেন যে রাশিয়ারও নিজস্ব স্বার্থ আছে।
“আজকের আলোচনা কেবল ইউক্রেইন সমস্যার সমাধানই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ব্যবসায়িক ও বাস্তববাদী সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ভিত্তি হয়ে উঠবে বলে আমি আশা করি,” বলেন পুতিন।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর চলে গেছে সাড়ে ৩ বছর। এখনও লড়াই চলছে।
সেই যুদ্ধ থামাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে নিয়ে যে বৈঠক ট্রাম্প করলেন, সেখানে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি।
কিইভের বাসিন্দারা এই আলোচনার ফলাফল নিয়ে সন্দিহান ছিলেন শুরু থেকেই। বৈঠক শুরুর পর জেলেনস্কি বলেছিলেন, সমঝোতার জন্য আলোচনায় বসেও রুশরা হত্যাকাণ্ড চালিয়ে গেছে। তবে বৈঠকের পর তাৎক্ষণিকভাবে কিইভের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
বৈঠকের শুরুতে আঙ্করেজের এয়ার ফোর্স ঘাঁটিতে পুতিনকে লাল গালিচায় স্বাগত জানানো হয়, ট্রাম্প তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান, তার প্রতি সম্মান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমান আকাশে উড়ে যায়।
২০২২ সালে ইউক্রেইনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার সামরিক অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এটাই ছিল পুতিনের প্রথম সাক্ষাৎ।
সেদিক দিয়ে এ বৈঠক তার জন্য ইতোমধ্যে বড় জয় এনে দিয়েছে। তিনি এখন দেখাতে পারবেন, ‘রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার’ যে চেষ্টা পশ্চিমারা বহু বছর ধরে চালিয়ে আসছে, তা ব্যর্থ হয়েছে, মস্কো আবারও আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রীয় মঞ্চে ফিরেছে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প আশা করেছিলেন, তিনি যদি যুদ্ধবিরতি এনে দিতে পারেন, তাহলে তা কেবল ওই অঞ্চলে শান্তিই ফেরাবে না, তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য একজন শান্তিদূত হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করবে।
সেই বিচারে এখন পর্যন্ত বৈঠকের ফল তার জন্য কিছুটা হতাশাজনকই বটে।
গত সাড়ে তিন বছরে ইউক্রেইন যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষর প্রাণ গেছে। তাদের একটি বড় অংশ ইউক্রেইনীয়।
ইউক্রেইন থেকে শত শত শিশুকে সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) পরোয়ানা জারি রয়েছে। রাশিয়া ওই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
সেই পরোয়ানা মাথায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভ্যর্থনা নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করে মস্কো ফিরে গেলেন ভ্লাদিমির পুতিন।
রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই আইসিসির সদস্য নয়। ফলে আলাস্কায় পুতিনকে গ্রেপ্তার করা হবে–এমন আশা বা আশঙ্কা কেউ করেননি।
যুদ্ধবিরতির খবর নেই
ট্রাম্প ও পুতিন তাদের শীর্ষ উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন আঙ্কোরেজের এয়ার ফোর্স ঘাঁটির একটি কক্ষে। ২০১৯ সালের পর এটাই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ।
ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তার লক্ষ্য হলো যুদ্ধ থামানো এবং পুতিনকে দ্রুত ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি করানো।
তবে জেলেনস্কির ইউরোপীয় মিত্ররা আশঙ্কা করছিলেন, ট্রাম্প হয়তো ইউক্রেইনকে ‘বিক্রি’ করে দেবেন; যুদ্ধ স্থগিত করে তিনি হয়ত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউক্রেইনের এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড রাশিয়ার বলে স্বীকৃতি দিয়ে দেবেন।
তবে ট্রাম্প বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি ইউক্রেইনের হয়ে কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করবেন না।
“আমি এখানে ইউক্রেইনের হয়ে দর কষাকষি করতে আসিনি, আমি তাদের আলোচনার টেবিলে বসাতে এসেছি।”
আলোচনা সফল হলে কী হবে জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেছিলেন: “আমি দ্রুত যুদ্ধবিরতি দেখতে চাই… যদি আজ না হয়, তবে আমি খুশি হব না । আমি চাই হত্যাযজ্ঞ থেমে যাক।”
জেলেনস্কি আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার হাতে কোনো ভূখণ্ড তুলে দেবেন না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে তিনি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান।
বৈঠক শেষে ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি জেলেনস্কি ও নেটো নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন, আলাস্কার আলোচনায় কী অগ্রগতি হল, সে বিষয়ে তাদের অবহিত করবন।
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, ট্রাম্পের রাশিয়া-সংক্রান্ত বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। অন্যদিকে পুতিনের সঙ্গে ছিলেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।
ট্রাম্প একসময় বলেছিলেন, তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেইন যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারবেন। তবে বৃহস্পতিবার তিনি স্বীকার করেছেন, কাজটি তার ধারণার চেয়ে কঠিন।
তিনি এও বলেছিলেন, শুক্রবারের বৈঠক সফল হলে জেলেনস্কিকে নিয়ে দ্রুত একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজন করাই হবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
জেলেনস্কিও আশা করেছিলেন, শুক্রবারের এই বৈঠক হয়ত একটি ‘ন্যায়সঙ্গত শান্তির’ পথ খুলে দেবে, ত্রিপক্ষীয় আলোচনার দিকে নিয়ে যাবে।
তবে আলোচনায় বসেই রাশিয়া যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, শুক্রবার রাশিয়ার একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র যে ইউক্রেইনের দনিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলে আঘাত হেনেছে, তাতে যে একজন নিহত এবং আরেকজন আহত হয়েছেন, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন জেলেনস্কি।
তিনি টেলিগ্রামে লিখেছিলেন, “এখন সময় এসেছে যুদ্ধ থামানোর, এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ রাশিয়াকেই নিতে হবে। আমরা আমেরিকার ওপর নির্ভর করছি।”
আলাস্কা বৈঠকের সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যের সমাপ্তি টেনে ট্রাম্প বলেন, তিনি সম্ভবত শিগগিরই আবার রুশ নেতার সঙ্গে দেখা করবেন।
পুতিন জবাবে বলেন, “পরের বার মস্কোতে।”
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh