শনিবার ভোররাতে ইরানে হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর এক পাইলট। ছবিটি প্রকাশ করেছে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ছবি : সংগৃহীত
ইরানে গতকাল শনিবার ভোরে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইরানের তিনটি প্রদেশের কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় তিন দফায় এই হামলা চালানো হয়। ১ অক্টোবর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে ইসরায়েল দাবি করেছে। একই সঙ্গে তারা ইরানকে আর হামলা না চালাতে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে রেখেছে।
ইরান বলেছে, ইসরায়েলের এসব হামলায় অন্তত দুজন সেনাসদস্য নিহত ও ‘সীমিত ক্ষয়ক্ষতি’ হয়েছে। ইরানের নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। তাদের এই পাল্টা হুমকির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইরানের পাল্টা হামলা নিয়ে নানা জল্পনাও চলছে।
গতকাল ভোররাতে ঠিক কখন থেকে ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করেছে, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। তবে গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় শনিবার গভীর রাত আড়াইটার দিকে ইরানের রাজধানী তেহরান, পার্শ্ববতী কারাজ ও পূর্বাঞ্চলের মাশহাদ শহরে অন্তত সাতটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এর পর থেকে সেখানে প্রায় চার ঘণ্টা হামলা চলতে থাকে। হামলার সঙ্গে সঙ্গে ইরানজুড়ে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়। ইসরায়েল অবশ্য ইরানের কোনো তেলক্ষেত্র বা পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়নি।
ইসরায়েল কী বলছে
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, শনিবার ভোরে তারা ইরানে বিমান হামলা শেষ করেছে। ইরানের অভ্যন্তরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন উৎপাদনকারী কয়েকটি স্থাপনা এবং আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় তিন দফায় হামলা চালানো হয়েছে।
এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীও (আইডিএফ) ইরানে হামলা চালানোর কথা স্বীকার করেছে। হামলার সাংকেতিক নাম ছিল ‘ডেস অব রিপেনট্যান্স’ বা অনুতাপের দিন। হামলায় কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়েছে। হামলা শেষে সব যুদ্ধবিমান নিরাপদে নিজ নিজ ঘাঁটিতে ফিরে এসেছে।
এর আগে কখনো ইসরায়েলি বাহিনী ইরানে কোনো হামলা চালানোর কথা স্বীকার করেনি।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, তেল আবিবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষ (বাংকার) থেকে ইরানে হামলা চালানো পর্যবেক্ষণ করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট।
ইরান যা বলছে
ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিভাগ জানিয়েছে, তেহরান, খোজেস্তান ও ইলাম প্রদেশের সামরিক স্থাপনায় ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে। এতে কিছু স্থানে ‘সীমিত ক্ষয়ক্ষতি’ হয়েছে।
ইরানের স্থানীয় কিছু সম্প্রচারমাধ্যমের ফুটেজে দেখা যায়, তেহরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো বাইরে থেকে আসতে থাকা কিছু ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্য করে অব্যাহতভাবে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে।
ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানায়, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) ঘাঁটিতেও হামলা চালানো হয়েছিল; কিন্তু সেখানে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
একই সময়ে সিরিয়ায়ও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছিল
ইরানে হামলা চালানোর বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে আগেই জানিয়েছিল ইসরায়েল। এক মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। হামলায় যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি বলেও জানান তিনি।
বাইডেন প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ইরানে ইসরায়েলের হামলাকে ‘সুনির্দিষ্ট ও আনুপাতিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, এই হামলার পর দেশ দুটির মধ্যে সরাসরি পাল্টাপাল্টি হামলার অবসান হওয়া উচিত। তবে ইরান হামলার প্রত্যুত্তর দিলে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ইরান-সমর্থিত হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া ও লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার জবাবে ১ অক্টোবর ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইরান। এর অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য মিত্রের সহায়তায় ভূপাতিত করেছিল ইসরায়েল।
তাৎক্ষণিক ওই হামলার বড় ধরনের জবাব দেওয়ার ঘোষণা দেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, ইসরায়েল ইরানের জ্বালানি তেল ও পারমাণবিক স্থাপনাতেও হামলা চালাবে। কিন্তু ইসরায়েলের এ ধরনের হামলার পরিকল্পনায় সমর্থন দিচ্ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ ধরনের হামলার পরিকল্পনার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছেন। এ অবস্থায় ইরানের তেল ও পারমাণবিক স্থাপনার পরিবর্তে অন্যান্য সামরিক স্থাপনায় হামলা চালাল ইসরায়েল।
পাল্টা হামলার শঙ্কা
গতকাল হামলার আগে ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তারা ইসরায়েলকে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন। গতকাল ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম কয়েকটি সূত্রের বরাতে জানায়, যেকোনো আগ্রাসনের জবাব দেওয়ার অধিকার রয়েছে ইরানের। ইসরায়েলকে সমানুপাতিক জবাব দেওয়া হবে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে গত বৃহস্পতিবার আইআরজিসি ইঙ্গিত দেয়, ইসরায়েলের হামলাকে ‘সীমিত’ মনে হলে এবং তাতে হতাহত না হলে ইরানের পাল্টা হামলা চালানোর তেমন একটা ‘সম্ভাবনা’ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস গতকাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইরান সীমিত পরিসরে পাল্টা হামলা চালাতে পারে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কর্মকর্তারা। তবে পাল্টা হামলা না চালাতে শুক্রবার ইসরায়েলের তরফে ইরানকে বার্তা দেওয়া হয়েছে।
ইরানে হামলা চালানোর পর ইসরায়েল নিজ দেশের সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ে এখনো নতুন করে কোনো নির্দেশনা জারি করেনি। এর অর্থ হলো, দেশটি শিগগিরই ইরানের পাল্টা হামলার আশঙ্কা করছে না।
প্রতিক্রিয়া
ইরানে ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, ‘আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে ইরানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আত্মরক্ষা অধিকার রয়েছে। একই সঙ্গে বলতে চাই, আঞ্চলিক উত্তেজনা যেন আর না বাড়ে, তা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।’
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ওই অঞ্চলের চরম উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে পারে, এমন যেকোনো ধরনের উসকানি ও পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে সব পক্ষকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে ফ্রান্স।
ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি অমান্য করে হামলার মাধ্যমে ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করায় নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব।
মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, হামাস, হিজবুল্লাহ, পাকিস্তানসহ আরও কিছু দেশ ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
বিষয় : সৌদি আরব ইরাক যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য ইরান
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh