ছবি | সংগৃহীত
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টিতে নেত্রকোনায় ফের অবনতি হয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও অনেক গ্রাম। এদিকে শেরপুর ও ময়মনসিংহে পানি না বাড়লেও ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় খাবারের কষ্টে পড়েছেন বানভাসিরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছে না বলে বন্যার্তদের অভিযোগ।
এদিকে বানের পানিতে ডুবে নেত্রকোনার দুর্গাপুরে এক বৃদ্ধ, শেরপুরের নকলায় এক শিশু ও ময়মনসিংহের ফুলপুরে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। শেরপুরে পাঁচদিনে বন্যার পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ জনে। গণমাধ্যম কর্মীদের পাঠানো খবর।
নেত্রকোনায় প্লাবিত ১৩১ গ্রাম: নেত্রকোনায় মঙ্গলবার ভোরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। এতে বন্যার পানি বেড়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনার ঝাঞ্জাইল এলাকায় ৬৫ মিমি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
সোমবার সকাল থেকে নেত্রকোনার আকাশে রোদের দেখা মেলে। ওইদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি। এতে বন্যাপ্লাবিত পাঁচটি উপজেলায় পানি সামান্য কমেছিল। কিন্তু মঙ্গলবারের বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নেত্রকোনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পূর্বধলার জারিয়া বাজার এলাকায় সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বিকাল ৫টার দিকে উব্দাখালীর পানি কলমাকান্দা ডাকবাংলো পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অবশ্য দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী ও সদর উপজেলার কংস নদের পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নেত্রকোনার ছোট-বড় সব নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া শেরপুরের ভোগাই-কংসের পানি জারিয়া এলাকায় কংস নদ দিয়ে কলমাকান্দায় উব্দাখালী নদীতে প্রবাহিত হয়। এতে দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর- পাঁচটি উপজেলায় বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
স্থানীয় সূত্র ও জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নেত্রকোনার বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ২৭টি ইউনিয়নে ১৩১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছেন ৬৫ হাজার মানুষ।
কলমাকান্দার নক্তিপাড়া গ্রামের নজরুল ইসলাম মঙ্গলবার বলেন, ‘পানি সকাল থেকে আরও বাড়ছে। ৩ একর জমিতে আমন ধান আবাদ করেছিলাম। বেশকিছু খেতের ধানগাছে শিষ ছাড়ছিল। কিন্তু বন্যার কারণে সব ধানগাছের ওপর তিন থেকে আট ফুট পানি। তিনদিন ধরে এ অবস্থা। মনে হয়, কোনো ধানগাছ আর টিকবে না।’
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘কিছুটা দম ধরে মঙ্গলবার সকাল থেকে পানি আবারও বাড়ছে। পূর্বধলার জারিয়া এলাকা কংস নদের তীরে থাকা বেড়িবাঁধটি দুই স্থানে ভেঙে গেছে। এরপর থেকে পূর্বধলা, সদর ও বারহাট্টার বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফসলি জমিরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। তবে বন্যা মোকাবিলায় আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদিকে চারদিনের অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার দুইটি পূজামণ্ডপের আঙিনায় পানি উঠেছে। এ কারণে পূজামণ্ডপ ও আঙিনা সুসজ্জিত করা যাচ্ছে না। নির্মাণ করা যাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন গেট ও প্যান্ডেল। তবে পূজা হবে যতারীতি, জানিয়েছেন পূজা কমিটির সভাপতি ও সম্পাদকরা। কলমাকান্দা উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুজন সাহা বলেন, দুর্গাবাড়ী নয়াপাড়া মহাশ্মশানঘাট ও যাত্রাবাড়ী পূজামণ্ডপের আঙিনায় পানি উঠেছে। তবে তারা পূজার সব প্রস্তুতি নিয়েছেন।
দুর্গাপুরে ডুবে বৃদ্ধের মৃত্যু: নেত্রকোনার দুর্গাপুরে ঢলের পানিতে ডুবে রুসমত খান (৬০) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। সোমবার বিকালে উপজেলার গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার সকালে চারপাশে পানি থাকায় সড়কের পাশে তাকে দাফন করা হয়। রুসমত খান ওই উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের মৃত আক্তার খানের ছেলে।
শেরপুরে বন্যার উন্নতি, ডুবে শিশুর মৃত্যু: অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে শেরপুরের সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদীতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যার উন্নতি হয়েছে। সোমবার বৃষ্টি না হওয়ায় পাহাড়ি ঢলের আগ্রাসন কমে গেছে। পাহাড়ি নদী মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই ও চেল্লাখালীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উজান থেকে ঢলের পানি নেমে ভাটি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে অনেক ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ঝিনাইগাতীসহ বন্যাকবলিত এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ভেসে উঠতে শুরু করেছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। এদিকে নকলা উপজেলার টালকি এলাকায় রাহিম নামে ৫ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন নকলা থানার ওসি হাবিবুর রহমান। এ নিয়ে ৫ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ জনে। শেরপুর সদর উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের বালুয়াকান্দা গ্রামের কৃষানি শিউলী বেগম বলেন, ‘বন্যায় ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা গেছেগা। চুলা ভিজা থাকায় রান্না বন্ধ। খাবার পাইতাছি না।’ একই গ্রামের গৃহিণী রহিমা বেগম বলেন, ‘খাবার নবার নাই। চুলাত আগুন জ্বলাবার পাইতাছি না। ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা গেছেগা। খেতের ফসল বানের পানিতে খাইয়া গেছেগা।’
ফুলপুরে ডুবে এক যুবকের মৃত্যু: ময়মনসিংহের ফুলপুরে বন্যার পানিতে ডুবে আনোয়ার হোসেন (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি সিংহেশ্বর ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের সেকান্দার আলীর ছেলে। মঙ্গলবার সকালে বাড়ি যাওয়ার সময় বন্যার পানির স্রোতে ভেসে যায়। পরে এলাকাবাসী তার লাশ উদ্ধার করে।
ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ): ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় বন্যায় ভেসে গেছে অন্তত ৩৩ কোটি টাকার মাছ। বিভিন্ন এলাকায় ফিশারি ডুবে গিয়ে ভেসে গেছে মাছ। এতে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন মাছচাষিরা। এদিকে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। ৪টি ইউনিয়নে পানিবন্দি রয়েছেন ৫০ হাজার মানুষ। উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া, বাঘবেড়, ধোবাউড়া সদর এবং গোয়াতলা ইউনিয়নে বন্যার পানি স্থিতিশীল রয়েছে। উপজেলা প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা যায়, ১২৭ কিলোমিটার রাস্তা পানির নিচে রয়েছে। পানিবন্দি মানুষের মাঝে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। তবে বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করছে উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মঙ্গলবার সকালে উপজেলার দর্শা বিলপাড় এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে উপজেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনী। অন্যদিকে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় বাড়িতে গিয়ে ঘরবন্দি মানুষের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেন বিএনপির যুগ্মমহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স।
হালুয়াঘাটে বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। উপজেলার বাড়িঘর ও সড়ক থেকে পানি নামছে। তবে পানি কমলেও বর্তমানে চরম দুর্ভোগের শিকার বানভাসিরা। বন্যায় অনেকের কাঁচা ঘর ভেঙে গেছে। পাকা ঘরেও আসবাবপত্রসহ যাবতীয় সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বাড়িঘর বসবাস করার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখনো অনেক জায়গায় ত্রাণ পৌঁছেনি। সড়কের আশপাশের বাসিন্দারা ত্রাণ পেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকেই এখনো প্রয়োজনীয় খাবার ও বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না। ফলে খেয়ে-না-খেয়ে সীমাহীন কষ্টে দিন কাটছে তাদের। ইতোমধ্যে পানিবাহিত ডায়রিয়া রোগী বেড়েছে।
‘তিনদিন ধরে ভাতের দেখা নাই’: ফুলপুর উপজেলার সিংহেশ্বর ইউনিয়নের কুলিরকান্দা গ্রামের ফারুক আহমেদের স্ত্রী মোছা. খাদিজা বেগম বলেন, ‘ঘরে বন্যার পানি উঠেছে। রান্নার সুযোগ নাই। তিনদিন ধরে পরিবারে ভাতের দেখা নাই। বাড়িঘর, গরু-ছাগল ও জিনিসপত্র রাইখা যাইমু কই? ঘরের চিড়া-মুড়ি খাইয়া এতদিন চলছি। আজ আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ভাত রান্না করে নৌকা দিয়া আনছে।’ তিনি আরও বলেন, কুলিরকান্দা গ্রামের ৩০০ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। এখন পর্যন্ত কেউ কোনো সহযোগিতা পায়নি। সবাই কষ্টে আছে। একই গ্রামের বৃদ্ধ হারেছ আলী (৬৫) বলেন, ঘরে পানি ওঠায় রান্না বন্ধ রয়েছে। খাওয়ার কষ্টে আছি। কারও সহযোগিতা পাচ্ছি না।
ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ): ধর্মপাশা উপজেলায় আবাদ করা ৪০০ হেক্টর আমন জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। আর মধ্যনগরে পাহাড়ি ঢলের পানি নামতে শুরু করলেও সড়ক ও বসতবাড়ির ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
রৌমারী (কুড়িগ্রাম): উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে রৌমারী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে জিনজিরাম নদীর অববাহিকায় রৌমারী-রাজিবপুর উপজেলার প্রায় ৩০টি গ্রামের ৫৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুইদিন ধরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো পানিবন্দি রয়েছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার। বানভাসিদের দুর্ভোগ কমেনি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh