ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার বর্তমান তাপদাহ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের ফলাফল বলে জানিয়েছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
চলমান এই তাপপ্রবাহের পেছনে ৭ কারণ উল্লেখ করেছেন এই গবেষক। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, স্থানীয় কারণ যা স্থানীয়ভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। এই স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া। এক সময় বাংলাদেশে ২৫ ভাগের বেশি সবুজায়ন থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ খুবই নগন্য। গাছপালা পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। ফলে বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে আশপাশের এলাকা শীতল রাখে। কিন্তু এখন শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে রাস্তার বিভাজনের বড় বড় গাছগুলোকে কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একই কারণে বৃষ্টিপাতও কমে যাচ্ছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির দ্বিতীয় অন্যতম কারণ হিসেবে জলাধার কমে যাওয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। জলাধার মাটির পরিবর্তে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এটিও তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ঢাকা শহরের ৩৬টি স্থান নিয়ে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে সেসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। এর মধ্যে ৯টি স্থানে ছিল তাপমাত্রা বেশি। কারণ এগুলোতে গাছপালা কম ছিল। আর বাকি ৯টি স্থানে বৃক্ষ বেশি থাকায় তাপমাত্রাও কম ছিল। আর অন্য ১৮টি স্থানে মধ্যমানের তাপমাত্রা ছিল। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জাতীয় চিড়িয়াখানায়। দ্বিতীয় কম তাপমাত্রার অন্য এলাকাগুলো ছিল, রমনা পার্ক, ধানমন্ডি লেক পাড়, ক্যান্টনমেন্টসহ কিছু এলাকা। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার এলাকা ছিল তেজগাঁও, মতিঝিল, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ কিছু বাণিজ্যিক এলাকা। এগুলোতে তিন থেকে সাড়ে তিন ডিগ্রি তাপমাত্রার তারতম্য ছিল। এতেই প্রমাণিত সবুজ জলাভূমি তাপমাত্রা কম কিংবা বৃদ্ধির অন্যতম উৎস।
তৃতীয়ত কারণ উল্লেখ করে ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকার অত্যাধিক জনসংখ্যাও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ইউএস-ইপিএ এর মতে সাধারণত প্রতি ১০ লক্ষ লোকের জন্য যেকোনও এলাকার তাপমাত্রা ১.৮-৫.৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বাড়তে পারে। আবার মানুষের শরীরের একটি নিজস্ব তাপমাত্রা রয়েছে যাকে বলা হয় মেটাবোলিক হিটিং এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই এই তাপমাত্রার পরিমাণ ১০০ ওয়াট। অর্থাৎ একই স্থানে যত বেশি সংখ্যক মানুষ থাকবে, সেই স্থানের তাপমাত্রা ততই বেশি হবে। ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটিরও বেশি যেটি প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। চতুর্থ কারণ হচ্ছে নগরের একটি বিশাল অংশের মানুষ রান্নার কাজে কাঠ পোড়ান। এর বাইরে নগরীতে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে। ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির চতুর্থ কারণ হল যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো। বর্জ্যের ভেতরে থাকা প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বিভিন্ন রকম দূষিত গ্যাস ও মাইক্রো প্লাস্টিক বস্তুকণা বাতাসের সাথে মিশে বাতাসকে দূষিত করছে। বাতাসে ভাসমান এই প্লাস্টিক কণাগুলো তাপ ধরে রেখে বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করে তুলছে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে এবারের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল প্লাস্টিক দূষণ। এবছর পরিবেশ দিবসের পঞ্চাশ বছর শেষ হলো। গত ৫০ বছর ধরেই পরিবেশ রক্ষার দাবিতে ৫ই জুন পরিবেশ দিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু দিনে দিনে পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের পরিবর্তন হচ্ছে যার প্রভাব পড়ছে আমাদের জীবন যাত্রার উপর। তাপমাত্রার অসহনশীল পরিবর্তনই এর অন্যতম উদাহরণ।
পঞ্চমত, রাজধানীর অধিক যানবাহন ও যানজট সমস্যাও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। যার মধ্যে রয়েছে রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় ৫২ লাখ গাড়ি। যার এক-তৃতীয়াংশ ফিটনেস বিহীন চলাচল করছে। যানজটের কারণে গাড়িগুলিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে ইঞ্জিন হতে প্রচণ্ড পরিমাণে তাপ নির্গত হয় যা বাতাসের সাহায্যে ছড়িয়ে পড়ে শহরের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে। ষষ্ঠ কারণের মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরের পিচঢালা রাস্তা। এই রাস্তা দিনের বেলা উত্তপ্ত হয় এবং রাতের প্রথমভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে থাকে। এরপর যখন তা রিলিজ করে তখন তা নগরে তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এ জন্য রাস্তার ডিভাইডারে গাছ প্রয়োজন। যা উত্তাপ কমাতে সহায়ক। কিন্তু এখন শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে ডিভাইডারের গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। তাতে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সপ্তম কারণ হলো নতুন করে তৈরিকৃত বহুতল ভবনগুলোতে অতিরিক্ত গ্লাসের ও এসির ব্যবহার এবং ভবনের ভেতরের সরু রাস্তা। এতে করে গ্লাসে ধারণ করা তাপ ও এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। আবার ভবনের ভিতরকার সরু রাস্তা বায়ুর স্বাভাবিক চলাচলকে বাধাগ্রস্থ করে যার ফলে দুপুরের চরম তাপ ভবনগুলির মাঝে ট্র্যাপ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই সন্ধ্যার পর ওই এলাকার তাপমাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হয়। অন্য দিকে ফুটপাথে ঘাসের পরিবর্তে এখন পাকাকরণ হচ্ছে যার কারণে পানি মাটিতে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে পাকার নিচের মাটিও উত্তপ্ত হয়ে যায়। যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সব মিলিয়ে বলতে হয় বর্তমান নগরায়ন, শিল্পায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমই তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।
একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, ২০৫০ সালের মধ্যে তাপপ্রবাহ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩.৫ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শহরে বসবাসকারী মানুষ। তীব্র তাপপ্রবাহ শহরগুলির জন্য বেশি বিপজ্জনক এবং প্রতি বছর শহরে ক্রমাগত ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রিজিলিয়ান্স সেন্টারের ‘হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিস’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ঢাকায় উচ্চতাপমাত্রার কারণে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্য যে কোনো শহরের তুলনায় উচ্চতাপমাত্রার ফলে ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা কমাতে উদ্যোগ না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ এ ক্ষতি ১০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে গরমকালের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায় অনুমান করা হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব দুর্বল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের উপর পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে তাপপ্রবাহের কারণে নভেল ভাইরাস এবং প্যাথোজেনগুলির বেঁচে থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগকে বাড়িয়ে তুলছে। উচ্চ তাপমাত্রায় ডিহাইড্রেশন, অ্যালার্জি, হিটক্র্যাম্প, হিটস্ট্রোক দেখা দেয়। গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং বর্ষাকাল অনেক দেরি করে আসে।
ঢাকা শহরের এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে গাছ লাগাতে হবে। রাস্তার বিভাজনে শোভাবর্ধনকারী গাছ ছাড়াও ভূমির ধরণের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম উপকারী বৃক্ষ যেমনঃ বিভিন্ন ফলের গাছ, ঔষধি গাছ, কাষ্ঠল গাছও রোপণ করতে হবে। ছাদ বাগান বৃদ্ধি করতে হবে। একটি বনাঞ্চল সরাসরি তাপ এবং কার্বন নির্গমন হ্রাস করে। ঢাকায় জলাভূমির পরিমাণও বৃদ্ধি করতে হবে। দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে। জলাভূমি ভরাট করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শহরাঞ্চল থেকে মানুষের আধিক্যতা কমাতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণের সময় সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে। যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্লাস্টিক বর্জ্যকে যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। শহরের স্থানীয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জননীতিকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহন করা জরুরী। সর্বোপরি সবাইকে এই তাপ প্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
বিষয় : তাপদাহ
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh