শোক দিবসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া কয়েকজনকে পেটানোর পর বেঁধে রাখা হয়।
জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যাওয়া নেতাকর্মীদেরকে বেঁধে নির্যাতনকে ‘স্বাধীনতা হরণ’ বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী।
১৯৭১ সালে টাঙ্গাইলে কাদেরীয়া বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বীর উত্তম খেতাব পাওয়া এই মুক্তিযোদ্ধা নিজেও বৃহস্পতিবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন, এরপর তিনি এমন প্রতিক্রিয়া জানান।
শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া মানুষদেরকে বেঁধে পেটানোর নিন্দা জানিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেন, “আমি দেখলাম- কয়েক জনকে বেঁধে রেখেছে। স্বাধীন দেশে কাউকে কোনোখানে বেঁধে রাখা যায়? এটা কোনো মানবিক ব্যাপার না, আমি এর নিন্দা জানাই এবং সরকারকে বলব, এটা বন্ধ করতে হবে।”
২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হাই কোর্টের আদেশে ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন হলেও সে ধারাবাহিকতায় এবার ছেদ পড়েছে।
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের তিনদিন পর শপথ নেওয়া মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠকে ১৫ অগাস্টের সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়। জাতীয় শোক দিবস নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো না হলেও রাষ্ট্রীয় কোনো আনুষ্ঠানিকতা এদিন ছিল না।
বরং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ যারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন, তাদের বেদম মারপিটের শিকার হতে হয়েছে, কাদেরকে পিটিয়ে বেঁধে রাখার পর সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
একজনকে পেটানোর পর বিবস্ত্র করার ভিডিও ছড়িয়েছে, আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, একজনকে ধানমন্ডি লেকে ফেলে পেটানো হয়েছে, তাকে পানি থেকে উঠতে বাধা দেওয়া হয়েছে, যারা ছবি বা ভিডিও ধারণ করেছে, তাদের ভিডিও ডিলিট করতে বাধ্য করা হয়েছে, সাংবাদিকদেরকে ছবি ও ভিডিও ধারণ না করতে হুমকি দেওয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে।
বুধবার মধ্যরাতেই হামলাকারীরা ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনের রাস্তায় অবস্থান নেয়। সকালে শুক্রাবাদ মোড় থেকে ৩২ নম্বর ও মেট্রো শপিংমলের সামনে অবস্থান নিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট দলে মিছিল করে।
৩২ নম্বর সড়কে লেকের পাড়ও তারা দখলে রেখেছেন। তাদের অনেকের হাতে লাঠি ও পাইপ দেখা যায়। পথচারী বা এলাকাবাসী যারাই আশেপাশের সড়ক ব্যবহার করেছে, তাদের সবাইকেই হয়রানি, গালাগাল ও হামলার শিকার হতে হয়েছে। এদেরই একজন কাদের সিদ্দিকী। লাঠিসোঁটা দিয়ে হামলা করে তার গাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বিস্তারিত জানান একাত্তরের কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আমার রক্ত আছে
ধানমন্ডি ২৭ নম্বর হয়ে ৩২ নম্বরের দিকে আসার সময় হামলা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আমার রক্ত আছে, আমি রুখে না দাঁড়ালে অনেক সন্তান তাদের পিতৃ পরিচয় পেত না, এই বিষয়গুলোকে বিবেচনা করতে হবে।
“আমার গায়ে হাত দেওয়া আমাকে অপমান করা মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা, স্বাধীনতাকে অপমান করা, বাংলাদেশকে অপমান করা।”
তার পরেও যদি বাংলাদেশের মানুষ নিরাপদ হয়, জানমাল হেফাজত হয়, সম্পদের নিরাপত্তা আসে এটাকে হাসি মুখে মেনে নেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
হামলাটা কীভাবে হয়েছে, সেই বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “আমি ভেতরে যাইনি, যাওবার চেষ্টাও করিনি। সামনে যারা ছিলেন তারা বলছেন যে ‘কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া আছে, আপনি আর যাইয়েন না’।
“আমি যখন ফিরতেছিলাম, এই সময়ই গাড়ির মধ্যে আঘাত করেছে, কাচ ভেঙেছে, সবগুলো কাচই ভেঙেছে। এতেও আমি মর্মাহত না, যদি দেশে শান্তি আসে।”
কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইল অঞ্চলে একটি বড় গেরিলা দল গড়ে তুলেছিলেন। যুদ্ধ শেষে অন্য যোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করলেও তিনি বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য কারো কাছে অস্ত্র তুলে দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। জাতির পিতা দেশে ফিরে টাঙ্গাইলে গিয়ে তার বাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র নেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কাদের সিদ্দিকী সশস্ত্র লড়াই চালান। বহু বছর তিনি দেশেও ফিরতে পারেননি। ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। সে সময় জেলায় জেলায় তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে হারলেও পরের নির্বাচনে জেতেন। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বিরোধের জেরে ১৯৯৯ সালে তিনি দল ছেড়ে গঠন করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।
১৫ আস্টের ছুটি বাতিল, হত্যাটা তো বাতিল হয়নি
শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগ ‘এক কথা না’ মন্তব্য করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, “শেখ হাসিনা আর বঙ্গবন্ধু এক কথা না, সরকার ১৫ আস্টের ছুটি বাতিল করেছে, কিন্তু হত্যাটাতো আর বাতিল করে নাই। তার জন্য শোক পালন তো মানুষের একটা অধিকার।
“আওয়ামী লীগ হয়ত একটা বিবৃতি দিয়েছে, একটা লিফলেট ছেড়েছে, তারা দলে দলে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাবে, অনুষ্ঠান করবে। এই জন্য যারা আন্দোলন করে সরকারকে হটিয়েছে, তারা ভয় পেতে পারে নিশ্চয়। কিন্তু তাদেরও সাবধানে থাকা দরকার।”
লাঠি হাতে দেশ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “৫ তারিখে সরকার পতন হয়েছে, আজকে ১৫ তারিখ, ১০ দিনেও যদি হাতে লাঠি থাকে তাহলে তারা দেশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না, মানুষের মন জয় করতে পারবে না।
“আমার মত মানুষের গাড়ি যদি ভাঙে, তাহলে কার নিরাপত্তা আছে? আমি তো চাই নিরাপদ বাংলাদেশ।”
ওরা কারা?
যারা হামলা করেছে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য কি না- এই প্রশ্নে কাদের সিদ্দিকী বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন? এরা আন্দোলন করেছে কিনা আমি বলতে পাব না। এখানে ছাত্রদের তো দেখলাম না। আমি তো কালকেও ছাত্রদের দেখে এসেছি। যারা কাজ করতেছে রাস্তাঘাটে রং করতেছে, ওই ৩২ এর পোড়া জিনিসগুলো সরাচ্ছে, সে রকম কাউকে আমি দেখলাম না। এদেরকে একটু যুবক মনে হল।
“আরেকটা জিনিস বলব, এই ছাত্রদের সফল আন্দোলন, এটা অনেকেই বিপথে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।”
শেখ হাসিনা সরকার তাকেও জেল খাটিয়েছে, তার কর্মীদের মেরেছে অভিযোগ করে জনতা লীগ নেতা বলেন, “আমার সম্মেলনের দিনে ১০৪ জন কর্মী আহত হয়োছিল, তার পরেও আমাকে হাসিনা বলে, আওয়ামী লীগ বলে আঘাত করবে। এটা তো সহ্য করার মত না।”
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh