বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের সকালে রাজধানীর সড়কে গণপরিবহন চলছে একেবারেই কম।
রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হলেও রাজধানীর সড়কে কোনো যানজট দেখা যায়নি।
সায়েন্স ল্যাব, এলিফেন্ট রোড, ধানমন্ডি মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, বিজয়স্মরণী, মহাখালী, বনানী, খিলক্ষেত, উত্তরা, আব্দুল্লাহপুরের সড়কজুড়ে গণ পরিবহন নেই বললেই চলে। এসব জায়গার সড়কে অল্প কিছু প্রাইভেট কার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে সেই সংখ্যা হাতে গোণা। এতে পথে বের হওয়া অফিসগামীরা পড়েছেন ভোগান্তিতে।
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনকটি এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার আহ্বান উপেক্ষা করে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো যোগ দিয়েছে। সঙ্গে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এদিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে অবস্থান কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি মিছিলের ডাক দিয়ে রেখেছে।
এসব কর্মসূচি ঘিরে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। মিরপুরের কালশী থেকে এক গণমাধ্যম কর্মী জানিয়েছেন, গুলশানে থেকে অফিসের যাওয়ার জন্য বের হওয়া তাসমিয়া আক্তার বলেছেন অনেক ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, “যে কোন সময় ঝামেলা বেঁধে যেতে পারে। বাস না পেয়ে মোটরসাইকেল করেই অফিসে যাচ্ছি। আজকে যে কী ঘটে, সেই ভয়ে আছি।”
কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতিও ছিল কম। পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যাও সেভাবে দেখা যায়নি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানে।
এদিকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হচ্ছেন না অনেকেই।
বেসরকারি চাকরিজীবী মোস্তফা কামালের অফিসের কাজ বাসায় বসে অনলাইনে করতে বলা হয়েছে।
“পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় অফিসে যেতে মানা করা হয়েছে। বলেছে, অনলাইনে থেকে কাজ করতে। খুব টেনশনে ছিলাম রাতে, পরে অফিস না থাকায় একটু চিন্তামুক্ত হলাম।”
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার
মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, মিরপুর ১৩ ও ১৪ নম্বর ও কচুক্ষেত এলাকা ঘুরে এসব এলকায় অটোরিকশার চলাচল বেশি দেখা গেছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এসব সড়কে হেঁটে বা রিকশায় চেপে বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছেন। বেলা আটটার আগে থেকে বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।
মিরপুর ১৪ নম্বর এলাকার অটোরিকশা চালক মো. ইমরান বেলা সোয়া দশটায় সাংবাদিকদের বলেন, “ সকাল থেকে যাত্রী কম। অন্যদিন এই সময় ছয়শ সাড়ে ছয়শ টাকার ট্রিপ হয়। আজ এখন পর্যন্ত আড়াইশ টাকা হইছে। রাস্তায় মানুষ কম, সবাই ভয়ে আছে।"
বেলা সাড়ে দশটা পর্যন্ত মিরপুর ১০ ও আশপাশের এলাকায় কোনো পুলিশ দেখা যায়নি, অধিকাংশ দোকানই ছিল বন্ধ। আওয়ামী লীগের কর্মীদের মিরপুর ১০ নম্বরে সড়কে অবস্থান করতে দেখা যায়।
ভুঁইয়া পরিবহনের বাসের সহকারী লোকমান সাংবাদিকদের বলেছেন আন্দোলন ঘিরে আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় তারা বেশি বাস রাস্তায় নামাননি।
“অল্প কিছু বাস চালানো হচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝে বাস বন্ধ করা হবে বা আরও বাস বের করব আমরা।”
এদিকে, বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার গণপরিবহন। আব্দুল্লাহপুর এলাকায় দূরপাল্লার গণপরিবহনের কাউন্টারগুলো বন্ধ রয়েছে। ফলে ঢাকার বাইরে যেতে চাওয়া যাত্রীরা পড়েছেন বিপাকে।
কাতার থেকে দেশে ফেরা প্রবাসী মো. তারেকুল ইসলাম বিমানবন্দর থেকে নিজ এলাকা কক্সবাজারের বাস ধরার জন্য আব্দুল্লাহপুর বাস কাউন্টারে এসেছিলেন। সেখানে সব কাউন্টার বন্ধ দেখে মালামাল নিয়ে কাউন্টারের সামনেই অপেক্ষা করছিলেন। কীভাবে যাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যেতে না পারলে হোটেলে থাকতে হবে। অনেকে বলেছে রাতে বাস ছাড়বে, রাতে চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারের বাস পেলে চলে যাবো।"
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শাহবাগ মোড়ে দু-একটি যাত্রীবাহী বাসের দেখা মিলেছে। মৎস্য ভবন এলাকায় অন্য দিন বিজিবির টহল থাকলেও রোববার তা চোখে পড়েনি। তবে শিল্পকলা একাডেমির ভেতরের মাঠে সেনা বাহিনীর কিছু গাড়ি (জিপ) দেখা গেছে।
সকাল ১০টার দিকে মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরা, পুরানা পল্টন, কাকরাইল, বিজয় নগর এবং হাতিরঝিল ঘুরে সাংবাদিকরা এসব সড়কে প্রাইভেট কার, রিকশা, থ্রি-হুইলার ছাড়া গণপরিবহন নেই। গুলশান থেকে নতুন বাজারের দিকে কয়েকটি মিনিবাস কেবল চলতে দেখা গেছে।
রিকশা চালক রনি বলেন, “কাস্টমার কমবেশি পাচ্ছি। ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনে গাড়ি-ঘোড়া রাস্তায় কম। দুপুরের দিকে পোলাপাই নামব শুনছি।”
সচিবালয় অভিমুখে রিকশা দিয়ে যাচ্ছেন শাহাবুদ্দিন তরফদার। তিনি একটি মন্ত্রণালয়ে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তার দুই ছেলে শামিল হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
শাহাবুদ্দিন বলেন, “দুচিন্তায় আছি আমার দুই ছেলেকে বার বার বলার পরও বন্ধুদের নিয়ে আন্দোলনে চলে যায়। আজকেও তারা যাবে। কি যে চিন্তায় থাকি।”
মোটর বাইক চালক সাব্বির বলেন, “গণপরিবহন একেবারেই কম। আমি সকাল থেকে গুলশানের পথে দুইবার আসা-যাওয়া করেছি। গণপরিবহনের বাস-মিনিবাস চলতে দেখিনি।
“ভাই এভাবে আর কতদিন। এটার একটা সমাধান হওয়া উচিত। গত কয়েকটা দিন আমরা খুবই কঠিন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি।”
স্কুলের কাছে দিয়ে মৎস্য ভবনের দিকে যাচ্ছেন সেলিমা রহমান। তিনি বলেন, “অসহযোগ দেখে নিজের গাড়ি বের করিনি। হেঁটেই যাচ্ছি। বাচ্চাদের আন্দোলন কিছু করারও নেই।”
কাকরাইল, বিজয়নগর, মালিবাগ, মৌচাক প্রভৃতি মোড়ে আগে ট্রাফিক সিগনালে পুলিশের অবস্থান দেখা গেলেও এদিন দেখা যায়নি।
তবে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গুলশান-১ এবং গুলশান-২ ট্রাফিক সিগনালে পুলিশ ও আনসার ব্যাটেলিয়ানের সদস্যদের বসে থাকতে দেখা গেছে।
যাত্রাবাড়ীতে সতর্ক পুলিশ
যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, শনির আখাড়া, রায়েরবাজার মহাসড়কে মাঝে মধ্যে শুধু সরকারি অফিসগামী যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে সকাল বেলায়।
এই এলাকা ঘুরে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, গত শনিবার রাত থেকে বন্ধ হওয়া গুলিস্তান ফ্লাইওভার বেলা সাড়ে দশটা পর্যন্ত খোলেনি।
দুই পাশের সড়কে যানবাহন, গণ পরিবহন চলাচল ছিল সামান্য। কোনো বাস চলেনি সকাল থেকে। গণপরিবহন, প্রাইভেট কার, চলাচল না করায় সড়ক ফাঁকাই দেখা গেছে।
গণপরিবহন না পেয়ে অফিসগামীরা রিকশায় চলাচল করেছেন যৌথভাবে ভাড়া দিয়ে।
রায়ের বাগ থেকে বেসরকারি অফিসগামী খালেদ সরকার সাংবাদিকদের বলেন, "আমি ছুটি চেয়েছিলাম, পাইনি। এই গরম পরিস্থিতিতে এখন রিক্সায় গুলিস্তান যাচ্ছি। যেতে পারলেও কিভাবে ফিরব তা জানি না।'
যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে পণ্যবাহী ছোটো ছোট ট্রাক চলাচল করেছে সবজি, কাঁচামাল নিয়ে।
এই এলাকার সড়কে আন্দোলনকারীদের দেখা মেলেনি বেলা সাড়ে দশটা পর্যন্ত। কাজলা, রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল।
যাত্রাবাড়ী থেকে সকাল ৮টার দিকে মতিঝিল যাত্রী নিয়ে গিয়েছিলেন ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালক নাদিম আক্তার।
সেখান থেকে পল্টন ও গুলিস্তানে যাওয়ার যাত্রী পেলে তাদের নামিয়ে ফের যাত্রাবাড়ীতে এসেছেন তিনি সাড়ে দশটায়।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, " যাওয়ার সময় গুলিস্তান পর্যন্ত কোনো বাস দেখি নাই। রাস্তায় খালি আমরা। অন্য সময় তো আমরা মেইনরোডে চলতে পারি না। আইজ পুলিশ কিছু কয়নায়।"
"রাস্তায় পুলিশ, রিক্সা, মোটরসাইকেল আর কিছু মানুষ আছে। তয়, যাত্রাবাড়ী খালি খালি লাগতাছে। গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিল কিছু মানুষ দেখা যায়।"
সম্পাদক ও প্রকাশক: আনোয়ার হোসেন নবীন
যোগাযোগ: +880244809006
ই-মেইল: [email protected]
ঠিকানা: ২২০/১ (৫ম তলা), বেগম রোকেয়া সরণি, তালতলা, আগারগাঁও, পশ্চিম কাফরুল, ঢাকা-১২০৭
© 2025 National Tribune All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh